দীর্ঘ তিন দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হতে চলেছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে। তবে দীর্ঘ সময়ের পর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যার জন্য আমরা সবাই আনন্দিত ও উত্ফুল্ল। এত দিন নির্বাচন না হওয়ার কারণে আমাদের জাতীয় রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি ও নেতৃত্ব বিকাশে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল, তা পূরণ হবে বলে আশা রাখি। আমাদের রাজনীতিবিদ কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি না হওয়ার বদৌলতে রাজনীতির এক বড় অংশ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের দখলে। তা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ দরকার। আমাদের ছাত্ররাজনীতির ছিল অতীতে উজ্জ্বল গৌরব ও ঐতিহ্য।
কিন্তু বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি ও হানাহানি আমাদের অতীত গৌরবের কথা ভুলিয়ে দেয়। ছাত্ররাজনীতির এমন নেতিবাচক দিক শুধু ছাত্রসংসদ না থাকার কারণে হয়েছে, তা শতভাগ ঠিক নয়। আমাদের কলুষিত রাজনীতির প্রভাব ছাত্ররাজনীতির ওপর ভর করেছে বিধায় আমরা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছি। আমাদের রাজনীতি আগেকার মতো নেই বিধায় সেখানে যখন পরিবর্তন হয় তখন তার প্রভাব ছাত্ররাজনীতির ওপর পড়ে। ফলে আমাদের গোটা রাজনীতি যেমন কলুষিত হচ্ছে, তেমনি ভালো নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার পথ রুদ্ধ হচ্ছে। আসন্ন ডাকসু নির্বাচন আমাদের অতীতের ছাত্ররাজনীতির দিকে কতটুকু ফিরিয়ে নিতে পারবে, তা বলা মুশকিল। কেননা আমাদের দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং লোভ-লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে পারাই এখানে বড় বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি একটি আবাসিক হলের ছাত্র ছিলাম। তখন প্রতিবছর হল ছাত্রসংসদ কর্তৃক অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সপ্তাহব্যাপী চলত এমন অনুষ্ঠান। হলের আবাসিক-অনাবাসিক সব শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারত। বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হতো। এর মধ্য দিয়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মেধাবীদের মূল্যায়ন করা হতো। এর বাইরেও হলে নিয়মিত অনুষ্ঠান, যেমন —বিতর্ক, খেলাধুলা ও বিভিন্ন জাতীয় দিবস হল সংসদ কর্তৃক উদযাপন করা হতো। শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব ছিল হল সংসদের। শুধু ছাত্ররাজনীতি কিংবা রাজনীতি কেন্দ্রিক নেতৃত্ব নয়, সংগঠক তৈরি করার এক কারখানা ছিল ডাকসু ও হল সংসদ। শিক্ষা শেষে কর্ম ও পেশাগত জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ভূমিকা ছিল সংসদের। যাঁরা পেশাগত রাজনীতিবিদ হতে চাইতেন, তাঁদের জন্য বড় সুবিধা ছিল ডাকসু ও হল সংসদ। মোটাদাগে রাজনীতিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলে ডাকসু ও হল সংসদের বিকল্প অতীতেও ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। কিন্তু যে কারণেই হোক, গত তিন দশক সেই প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল এবং আমরা আবার চালু করতে চলেছি। নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় এবং এখন চলছে প্রচার-প্রচারণার কাজ। প্রার্থীরা ক্যাম্পাস ও হলে হলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
অতীতের ডাকসু নির্বাচনের সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো —এখানে গতানুগতিক ছাত্রসংগঠনের বাইরে দু-একটি সংগঠন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এবার রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের জন্য এটি একটি ভালো দিক। নেতৃত্ব রাজনীতির বাইরে নয়। সবার উদ্দেশ্য যখন এক হয় এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আমরা যখন সচেতন হই এবং নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করি ও একত্র হই, তখন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন হওয়া কিংবা না হওয়া বড় বিষয় হয়ে দেখা দেয় না।
ইতোমধ্যে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় কোনো সহিংস ঘটনা আমরা লক্ষ করিনি। তবে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে কিছু কিছু অভিযোগ উঠেছে। ক্রিয়াশীল সব ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে; কিন্তু যে অভিযোগগুলো ইতিমধ্যে উঠেছে, সেগুলো নির্বাচন পরিচালনা কমিটির গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা উচিত বলে আমরা মনে করি। প্রচারণায় যেন সব সংগঠন সমান সুযোগ পায়, তার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নইলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদের বিষয়টি উল্লেখ নেই। তারা চাইছে আইন সংশোধন করে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে। তাই আমাদের জন্য ডাকসু নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডাকসু নির্বাচনের যে সুবাতাস বইছে, তাকে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের আগামী দিনের রাজনীতি পরিশীলিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্ধারণ করার জন্য অনেকে ডাকসুকে মিনি সংসদ হিসেবে দেখে। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হলে রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তনের আশা থাকবে না। তারা যদি বর্তমানের মতো চলতে থাকে, তাহলে নেতৃত্বের পরিবর্তন হবে; কিন্তু সেই নেতৃত্ব আর অতীতের ডাকসুর নেতৃত্বের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সাবেক ডাকসুর এক বড় নেত্রীর পত্রিকার একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি নিজের ঘড়ি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে প্রেস থেকে লিফলেট এনে বিতরণ করেছেন। বর্তমান সময়ের নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে এমন আচরণ পাওয়া সত্যিই বিরল। এখনকার সময়ে দেখা যায় ছাত্রনেতারা গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে যায়। এখন হয়তো ঘড়ি বিক্রি করতে হবে না; কিন্তু মনোনয়ন, টেন্ডার বাণিজ্য ও প্রভাব বিস্তারের মতো কলুষিত রাজনীতি থেকে তো আমরা মুক্তি পেতে পারি। রাজনীতি যদি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ থাকে এবং নেতাদের অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার বিপরীতে অবস্থান করে, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়বে বৈ কমবে না। ছাত্ররাজনীতি সৎ ও মেধাবী হলে জাতীয় রাজনীতিও তাই হবে। আমরা তা চাই, নইলে রাজনীতি যেভাবে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। দীর্ঘ সময়ের পর আমাদের সামনে এসেছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুতের। একে ধরে রাখতে হবে, যার অর্থ ডাকসুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা এবং এর মাধ্যমে আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্ব আমরা আশা করছি।
লেখক: অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ