অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ। ছায়াঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাসের এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচিত ছিল।
এক সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, পরীক্ষায় দেশসেরা ফল কলেজের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করলেও কালের পরিক্রমায় কলেজটির অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন বিভাগ ও ভবন হলেও শিক্ষার মান বাড়েনি।
নানা সংকটে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থী অনুপাতে আবাসন সমস্যা প্রকট। শিক্ষক সংকটও ব্যাপক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১২১ বছরের কলেজটির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান সুশীল সমাজের।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যানুরাগী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী পাবনা ইন্সটিটিউশন (জিসিআই বা গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশন) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সূচনা করেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে পাবনা ইন্সটিটিউশনের একটি কক্ষে তিনি কলেজ স্থাপনের সূচনা করেন। মাত্র ২৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘পাবনা কলেজ’ নামকরণ করা হয়। এ সময় গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী একই সঙ্গে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর এফএ স্ট্যান্ডার্ড কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তম এডওয়ার্ডের নামে ‘এডওয়ার্ড কলেজ’ নামকরণ করা হয়।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ পরিদর্শনে গভর্নর লর্ড টমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল এলে তাকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানে কলেজের উন্নয়নে তাড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায় ৫০ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করেন। গভর্নর কারমাইকেলও সমপরিমাণ টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়ার আমলা সদরপুরের জমিদার প্যারীসুন্দরী দাসীর উত্তরাধিকারী গোপী সুন্দরী দাসী ও দেবেন্দ্র নারায়ণ সিংহ কলেজকে সাড়ে ৪৬ বিঘা জমি দান করেন। এ সময় বিভিন্ন এলাকার বিদ্যানুরাগী জমিদাররা কলেজের উন্নয়নে জমি ও অর্থ দান করেন।
১৯১৫-১৬ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৬১ সালে কলেজের মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ একর। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ এডওয়ার্ড কলেজ সরকারীকরণ করা হয়। ছায়াঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাসবিশিষ্ট কলেজটিতে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, ছাত্র রাজনীতি ও সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত সমানতালে।
জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, পরীক্ষায় দেশসেরা ফল কলেজের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে আলী আসগার সম্পাদিত কলেজ বার্ষিকী পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও এখানকার শিক্ষার্থীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন।
কলেজের কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- বিশ্বের প্রথম বাঙালি শল্যচিকিৎসক ডা. অশোক বাগচী, কবি গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, ভারতবর্ষের প্রখ্যাত নকশাল ও মাওবাদী নেতা চারু মজুমদার, বাম নেতা মোফাখ্খার চৌধুরী, লেখক ঔপন্যাসিক সরদার জয়েনউদ্দীন, আইইউটির (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, রাবির সাবেক ভিসি ও কূটনীতিক এম সাইদুর রহমান খান, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বাম নেতা টিপু বিশ্বাস, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, দুদকের সাবেক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, স্কয়ার গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান স্যামুয়েল এস চৌধুরী (স্বপন চৌধুরী) প্রমুখ।
এডওয়ার্ড কলেজের সর্বকালের সেরা শিক্ষার্থী প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, মাখন লাল চক্রবর্তী নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। ছুটির সময় আমাদের বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়াতেন। কোর্স কমপ্লিট করে দিলেও কোনো টাকা নিতেন না। জোর করেও তাকে আমরা কোনো টাকা দিতে পারিনি।
এসব মনে পড়লে এখন চোখে জল আসে। তিনি বলেন, এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র হিসেবে গর্ববোধ করি। তিনি বরেন, সে সময় পড়ালেখা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সমান তালে চলত। ছাত্র সংসদের কার্যক্রমও চলত।
নির্বাচন হলেও কোনো মারামারি হতো না। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়া করত। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী বিভাগে আইএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন ড. আনোয়ার। এরপর আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বুয়েট) তিনি পড়ালেখা করেন।
বুয়েটে ২৫ বছর শিক্ষকতা এবং গাজীপুর আইআইটি ও বেসরকারি আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমান সংস্কৃতি সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র হিসেবে আমার গর্ব হয়। তিনি বলেন, সে সময় পড়ালেখার পাশাপাশি ক্যাম্পাসজুড়ে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল।
এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এএসএম ফরিদ বলেন, তখন ক্লাসের পড়া ক্লাসেই হতো। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না। শিক্ষকদের মধ্যেও আগের মতো সেই নীতি-নৈতিকতা নেই।
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের রসায়ন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় শুধু রাজশাহী বিভাগে নয়, সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন ফরিদ। ২৪তম বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকারি কলেজে যোগ দেন।
বতর্মানে কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪ হাজার। ১৮টি বিভাগের মধ্যে ১৫টিতে অনার্স-মাস্টার্স এবং দুুটিতে (ফিন্যান্স ও মার্কেটিং) শুধু অনার্স কোর্স পড়ানো হয়। একটি বিভাগে (আরবি ও ইসলামি শিক্ষা) ডিগ্রি পাস কোর্স রয়েছে।
সম্প্রতি নতুন কয়েকটি ভবন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য, শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নানা সমস্যায় জর্জরিত কলেজটি। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। ১৬৭ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও এর মধ্যেও দীর্ঘদিন ৩৪টি শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিভাগে দীর্ঘদিন কোনো শিক্ষক নেই। হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষকরা ওই দুটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা নিয়মিত ক্লাস নেন না। বিশেষ করে সিনিয়র শিক্ষক বা অধ্যাপকদের অনেকে মাসের প্রথমে এসে শুধু বেতন তুলে নিয়ে যান।
অনেক শিক্ষক কলেজে ঠিকমতো ক্লাস না নিয়ে প্রাইভেট পড়াতে বেশি গুরুত্ব দেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এ কলেজ থেকে এইচএসসি তুলে দেয়া হয়। কিন্তু দাবির মুখে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবারও এইচএসসিতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়। এদিকে ১৮ বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক অনেক কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল থেকে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মিঠু সহসভাপতি (ভিপি) এবং একই দলের কেএম হাসানুর রহমান রনি সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। এরপর আর ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। হাসানুর রহমান রনি জানান, ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় মানসম্পন্ন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অতীতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল এখন তার আর নেই।
তিনি বলেন, অনেক বছর আগে কলেজে ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা হলেও এখনও তা আধুনিক মানের হয়নি। অথচ ব্যায়ামাগারের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়া হয়। পরিবহন খাতেও চাঁদা নেয়া হয়। কিন্তু পরিবহন সমস্যা রয়ে গেছে।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আবাসন ও পরিবহন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। কলেজে ২৪ হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও যাতায়াতের জন্য মাত্র পাঁচটি বাস রয়েছে। আবাসিক হলের পাঁচটির বয়স প্রায় ৬০ বছর।
সম্প্রতি দুটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হলেও চালু হয়নি। নতুন দুটিসহ সাতটি হলে মোট আসন সংখ্যা ৮০০। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকারী প্রফেসর নিত্য গোপাল বলেন, সে সময় কয়েকজন দক্ষ শিক্ষক পেয়েছিলাম।
তিনি বলেন, শুধু আন্তরিকতা বা ভালোবাসা দিয়ে সব পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় না। কঠিনও হতে হয়। তিনি বলেন, কলেজের ঐতিহ্য রক্ষায় অধ্যক্ষ-শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. হুমায়ন কবির মজুমদার বলেন, কলেজের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুরো ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরা, কেন্দ্রীয় ওয়াই-ফাই সংযুক্ত করা হয়েছে। কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমান উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আহসান হাবিব বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে একটি রোল মডেল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
পাবনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর শিবজিত নাগ বলেন, এ কলেজের সরকারীকরণ মোটেই ভালো হয়নি। কারণ সরকারীকরণ করার পর মুক্ত ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ক্রীড়া, নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ধরে রাখা যায়নি।
তিনি বলেন, এখন অনেক আর্থিক সামর্থ্য বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। কাজেই জনপ্রতিনিধি, কলেজ প্রশাসন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠকে গর্বের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শতভাগ ক্লাসমুখী না হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।