দেশের ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডে সরকার রীতিমতো বিব্রত। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। শিক্ষক হয়ে অশিক্ষকসুলভ আচরণ করায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও। বর্তমানে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা চলছে। এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার।
জানা গেছে, অভিযুক্ত উপাচার্যরা সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেছেন নিয়োগ নিয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কোনো নিয়মই তারা মানতে চাইছেন না। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে কয়েকজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এসব অনিয়ম নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কমিটি।
তদন্তের জালে ১১ ভিসি :ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর খোন্দকার নাসিরউদ্দিন, ঢাকার ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এস এম ইমামুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মো. আবদুস সাত্তার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এম অহিদুজ্জামান, ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মু. আবুল কাশেম এবং রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর কামাল উদ্দিন আহাম্মদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তদন্ত চলছে।
আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও এখনও তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি বলে জানা গেছে।
অভিযোগসমূহ :সূত্র জানিয়েছে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। নিয়োগ স্থগিত রাখার নির্দেশ থাকার পরও সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এসব নিয়ে ক্ষোভ দমাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপকে ব্যবহার করার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের জুনে নোবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান। তারপর থেকেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি তদন্ত কমিটি নোয়াখালীর সার্কিট হাউজে যায়। কিন্তু উপাচার্যপন্থি কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকদের সশস্ত্র মহড়ায় ভীত হয়ে কমিটি তদন্ত না করেই ঢাকায় ফিরে আসে।
পূর্বের উপাচার্যের অনিয়মের ধারাবাহিকতায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেকৃবির চারটি অনুষদে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও লেকচারার পদে ৭৫ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন বিভাগের মৌখিক পরীক্ষা শেষে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ১০১ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদান করা হয়, যা বিজ্ঞাপিত চাহিদার চেয়ে ২৬ জন বেশি। এর মধ্যে ২১ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনের অপেক্ষায় রাখা হয়, যা ইউজিসি আইনের পরিপন্থি।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে তার ঘনিষ্ঠজনদের ঘুষ-বাণিজ্য ছাড়াও উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও আঞ্চলিকতার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক পদে থাকা ও ভাতা গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা, শিক্ষকদের দায়িত্ব বণ্টনে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতিসহ ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধেও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর নানা অনিয়ম সবার মুখে মুখে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ১৪২ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন তিনি। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামি থাকারও অভিযোগ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এই মুহূর্তে দেশের আলোচ্য বিষয়। নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিয়োগ, নিজের নামে কোটা করে ছাত্র ভর্তি, বিনা দরপত্রে কেনাকাটা, ভুয়া ভাউচারে খরচ দেখানো থেকে শুরু করে ছাত্রী নির্যাতন, নিজের বাসভবনে বিউটি পার্লার খোলা পর্যন্ত নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে ইউজিসি।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী এম শহীদুল্লাহ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সরকার সেই আলোকে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের পরামর্শ এই শিক্ষাবিদের।
এদিকে সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহর বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শত দশ কোটি চৌষট্টি লাখ টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। আত্মসাতে জড়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিরীক্ষা অফিসে জমা দিতে বলা হলেও তা করেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা। আপত্তির খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে পরস্পর যোগসাজসে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ডকুমেন্টস্ সৃজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় জমি কিনে বাসভবন স্থাপনের নামে প্রায় ৯০ কোটি টাকা মেরে দেয়া। জমি/বাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় ভ্যাট ও উৎস কর পরিশোধের নামে পঁয়ষট্টি লাখ সাতষট্টি হাজার টাকা এবং বিবিধ খরচ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল হতে পঁচিশ লাখ টাকা আত্মসাৎ। জমি/বাড়ি নামজারি করার নামে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে চব্বিশ লাখ টাকা অগ্রিম উঠিয়ে আত্মসাতের বিষয় রয়েছে।
তিন অর্থবছরে ৪১০ কোটি টাকার অডিট আপত্তির মধ্যে ২০১৬-১৭ বছরের দুই শত আটাশি কোটি বাষট্টি লাখ, ২০১৫-১৬ বছরের ষোল কোটি বাষট্টি লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ১০৫ কোটি আটত্রিশ লাখ টাকা রয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থ বছরের অডিট রিপোর্টে অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক ২০১ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করার আদেশ অমান্য করে তাদেরকে চাকরিতে বহাল রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি এগার কোটি ছাব্বিশ লাখ টাকা। এছাড়া পরীক্ষার পারিতোষিকের ওপর উৎস কর কর্তন না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি পাঁচ কোটি আটচল্লিশ লাখ টাকা। অবৈধভাবে চার কোটি সাতানব্বই লাখ টাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অগ্রীম উঠিয়ে সমন্বয় ভাউচার বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা।
গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে পরীক্ষার পারিতোষিক থেকে উৎস কর বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা না দিয়ে আট কোটি ষাট লাখ পঞ্চাশ হাজার এবং সরকারের অনুমোদন না নিয়ে মালামাল ক্রয় করে একান্ন কোটি ঊনচল্লিশ লাখ একচল্লিশ হাজার টাকার ক্ষতি। এছাড়া সোনালী ব্যাংকে সুদের হার বেশি হওয়া সত্ত্বেও কম সুদে অন্য ব্যাংকে এফডিআর করে ক্ষতি একান্ন লাখ একান্ন হাজার টাকা, পরীক্ষার খাতা বাঁধাইয়ে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করে বার কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা এবং প্রয়োজন নিরূপন ও দাপ্তরিক প্রাক্কলন ছাড়া প্রতিটি খাতার মূল্য, বাঁধাই, ওএমআর ও কভারপেজ মুদ্রণ করে ঊনপঞ্চাশ কোটি পঁচাত্তর লাখ বাহাত্তর হাজার পঞ্চাশ টাকার ক্ষতি। এছাড়াও বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ও দাপ্তরিক প্রাক্কলন ছাড়া মালামাল ক্রয় করে আটষট্টি কোটি একত্রিশ লাখ বিয়াল্লিশ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন খাতে দুই শত আটাশি কোটি বাষট্টি লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বড় কর্তারা।
অডিট আপত্তির বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বলেছেন অডিটের আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু আপত্তিগুলো খাতওয়ারি প্রদেয় অর্থ দায়ী ব্যক্তিদের নিকট থেকে ফেরত নিয়ে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করেছেন কি-না তা জানাতে পারেননি তারা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. শফিক উল্লাহ সম্প্রতি দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ২০১২ থেকে ২০১৪ অর্থ বছরের আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। পরের গুলোর তথ্য এখনি জানায়নি অডিট অধিদপ্তর।