ফেব্রুয়ারি-মার্চ দেশাত্মবোধের মাস। ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা এঁদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। গান-বৈঠক-সেমিনার। পাশাপাশি এগুলো পুরস্কারের মাসও। বাংলা একাডেমি-একুশে পদক দেওয়া হয়। এরপর স্বাধীনতা পুরস্কার। আর পুরস্কার দেওয়া নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডও বিস্তর ঘটে। গতবার স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটেছিল। এক উচ্চপদস্থ কর্তা পেয়ে গেলেন, যাঁর সঙ্গে মূলধারার সাহিত্যের সেই অর্থে যোগাযোগ নেই। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বেচারার পুরস্কার বাতিল হলো। তারপর দেওয়া এক বেদনাবিধুর সাক্ষাৎকারে সেই মানুষটির আর্তি কানে বাজে আজও, ‘কেনই বা দিল, কেনই বা নিল।’ এসব পুরস্কার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসটা এখন এ রকম। দু-একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয়কে দেওয়া হবে (যারা অনেক পুরস্কারে ভূষিত, এমন পুরস্কার পেলে না পেলে কিছু যায়-আসে না) গ্রহণযোগ্যতার পর্দা হিসেবে। এর আড়ালে কয়েকজন পাবেন স্তাবকের কোটায়। নিরপেক্ষ ধরনের এক-আধজনকে দিয়ে ওদিকটাও ঠিক রাখা হবে, যাতে দলবাজির অভিযোগ উঠলে বলা যায়, অমুক কোন দল করে, অ্যা! তা ছাড়া অন্য পক্ষ কাউকে দিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে হাওয়া বদলালেও সুবিধা হয়। একটা পুরস্কার দিতে গিয়ে যে পেছনের মানুষরা কত রকম পাটিগণিত-বীজগণিত মেলান। আর তাই পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পর কেউ কেউ লড়াই করে পুরস্কার আদায় করে নেন। একজন নন্দিত কবি, কয়েক বছর আগে এভাবে পুরস্কার নিয়েই ছেড়েছেন। আবার হুমায়ুন ফরীদি মারা যাওয়ার পর তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা রীতিমতো সংগ্রাম করে পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছে।
দু-একটা পুরস্কার পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। একবার একটা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে; কিন্তু সপ্তাহ যায়, মাস যায় পুরস্কারের আর খবর নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই তালিকার সবচেয়ে সম্মানিত যে পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর সময় হচ্ছে না। তিনি সময় দিলেই পুরস্কার বিতরণের তারিখ চূড়ান্ত হবে। একসময় ওনার সময় হলো। নির্দিষ্ট দিনে পুরস্কার নিতে গিয়ে দেখি প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি কেউ নন, যাবতীয় আয়োজন সেই পুরস্কার প্রাপককে ঘিরেই। ঘোষকও বারবার বলছেন, আজ পুরস্কার পাচ্ছেন অমুক...। তিনি জনপ্রিয় মানুষ। দর্শকরাও তাঁর নাম শুনে খুব হাততালি দিচ্ছে। ঘোষক হাততালির লোভে তাঁর নাম আরো জোরে উচ্চারণ করেন। আরো হাততালি পড়ে। যা হোক, তিনি এলেন। পুরস্কার বিতরণী শুরু হলো। সেই পুরস্কার দেখে প্রায় সবার মাথায় হাত। চমৎকার কারুকাজখচিত পুরস্কার যদিও, কিন্তু বিশাল সাইজের কারণে এটা বহন করে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চিন্তায় সবাই অস্থির। পুরস্কার হাতে নিয়ে অবস্থা এমন হলো যে এক-আধবার মনে হলো ফেলে দিয়ে ভেগে যাই। সম্ভব না। প্রথম জীবনের পুরস্কার। খুবই মূল্যবান জিনিস। পুরস্কারপ্রাপ্তরা তাই দেখার বস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। পুরস্কার বিতরণীর প্রধান আকর্ষণ, মানে তারকা লেখকের সেই সমস্যা নেই। তাঁর বোঝাটা সাগ্রহে অন্য কেউ একজন হাতে নিয়ে পেছন পেছন ঘুরছে। সমস্যা দেখা দিল তখন, যখন সেই পেছনের ছেলেটি নিখোঁজ হয়ে গেল। ওদিকে ওনার গাড়ি এসে গেছে, ছেলেটাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল এই পুরস্কারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই; কিন্তু এখন দেখা গেল মুখ কালো হয়ে গেছে। চোখ পড়ল আমার দিকে। ভঙ্গিতে কেমন যেন সন্দেহের তীর। মনে হলো, হঠাৎ যদি তিনি বলে বসেন, ‘এটাই মনে হয় আমারটা... দেখো তো একটু।’ তাহলে আয়োজকরা নিশ্চিত আমারটা নিয়ে ওনাকে দিয়ে দেবেন। আমি অজানা আতঙ্কে পুরস্কারটা শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম। যা হোক, কিছুক্ষণ পর ছেলেটিকে পাওয়া গেল। সে বাথরুমে গিয়েছিল। আয়োজকরা রক্ষা পেলেন। আমিও রক্ষা পেলাম।
পুরস্কারের ভেতরের ফাঁকিটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। একজনকে পুরস্কার দিয়ে এর মান বাড়ানো কিংবা নাম কামানোর জন্যই আয়োজন। বাকিরা দুধ-ভাত। শুনে আয়োজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন বললেন, ‘তুমি শুধু দোষটা দেখলে; কিন্তু এর মধ্যে যে নতুনদের জন্য আন্তরিকতাটা আছে সেটা খেয়াল করলে না।’
‘কী রকম?’
‘একজন বড় মানুষকে পুরস্কার দেওয়ায় মিডিয়া এসেছে। ওনার জন্য খবরটা ছাপা হবে। নাম ছাপা হবে তোমাদের। না হলে তো কিছুই হতো না।’
‘বুঝলাম, কিন্তু এটা তো ঠিক নৈতিক কাজ হলো না?’
‘নৈতিক কাজ না, তাহলে কোনটা নৈতিক কাজ? যেখানে সব পুরস্কার দেওয়া হয় ও রকম নামিদের আর পয়সাওয়ালাদের? আমরা তো মন্দের ভালো।’
সময়ে মন্দের ভালো, মন্দ, মন্দের মন্দ—এসবই দেখা হয়েছে। কিছু পুরস্কার তো আছে এ রকম যে, পুরস্কৃত হিসেবে আপনার নাম ঘোষণা করবে, এরপর হাজির হবে। শিল্প-সাহিত্যে অবদানের কথা বলে ফেনা তুলে ফেলবে। তখন আপনি একটু নরম হলেন। হয়তো এর মধ্যে দু-চারজনকে বলেও ফেলেছেন পুরস্কার পাওয়ার কথা। এ সময় হঠাৎ শুনবেন, ওদের যে মূল পৃষ্ঠপোষক তিনি একটু সমস্যায় পড়ে গেছেন। তাই সামান্য টাকা যদি...না না ধার হিসাবে। গাড্ডায় পড়ে গেলেন। মান বাঁচালেন। কিন্তু আসলে বিপদকে ডাকলেন। আপনাকে পুরস্কার দিলে মূল্য পাওয়া যায় শুনলে একে একে আসতে থাকবে একরাশ সাহিত্যমুখী। আমার পরিচিত এক লেখক লেখালেখিতে নেমেই পুরস্কারে ভাসতে থাকল। আমরা চমকিত, ওর সাহিত্যপ্রতিভা এত দ্রুত এত দিকে ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে? ফরিদপুর, রাঙামাটি, লালমনিরহাট—সারা দেশে ওর সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি। কিছুদিন পর পুরস্কার নিয়ে আলোচনা উঠলে দেখি মুখ ভার করে থাকে। শেষে এক দুর্বল মুহূর্তে স্বীকার করে ফেলল, ‘কী যে ঝামেলায় পড়লাম। স্বীকৃতি পেতে প্রথম দু-একবার কিছু টাকা দিলাম। এখন প্রতিদিন পুরস্কার দিতে আর টাকা নিতে লোক আসে।’ পুরস্কারের ফাঁদে পড়ে বেচারার বিপন্নতায় খারাপ লাগছিল, আবার রাগও হচ্ছিল।
জাতীয় পর্যায়ে অবস্থা নিশ্চয়ই অত খারাপ নয়। টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপার এভাবে ঘটে না। ঘটলে এত অন্যভাবে যে আমাদের সাধারণের মাথার ওপর দিয়ে সেসব যাবে। সেগুলো থাক, যেগুলো আমাদের মাথার আশপাশে আছে, সেগুলোতেই বরং থাকি। এটা বুঝতে পারি না, কেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে এসব পুরস্কারের জন্য তালিকা চাইতে হবে। মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দপ্তরের আমলাতান্ত্রিকতার হাতে শিল্প-সাহিত্য ছাড়লে কী হয় এটার বহু প্রমাণ দেখার পরও আমাদের শিক্ষা হয় না কেন? আবার আবেদনও করতে হয়। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগে অবাক হয়েছি এই জেনে যে, এটার জন্য আবেদন করতে হয়। ভাবুন, সাকিব আল হাসান বা মাশরাফিকে আবেদন করতে হবে। সেখানে লিখতে হবে, আমি বাংলাদেশ দলের জন্য এই-এই করেছি, কাজেই আমাকে পুরস্কার দিতে মহোদয়ের মর্জি হয়। বড় খেলোয়াড়দের অনেকেই আবেদন করেন না। সাধারণরা সুযোগটা নেয়। নয়ছয় হয় বিস্তর। আরেকটা সমস্যা, মরণোত্তর পুরস্কার। মৃত্যুর পর স্বীকৃতিতে আসলে তেমন কিছু যায়-আসে না। দিলে জীবিত থাকতেই দেওয়া উচিত। নইলে বাদ।
শেষে আরেকটা গল্প। ঢাকার বাইরে থেকে আসা এক তরুণের সঙ্গে আলাপ একবার, ওদের একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে যেতে খুব অনুরোধ করল। কারা পুরস্কার পাচ্ছেন, এ রকম কয়েকজনের নামও বলল। গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। শত শত মানুষ। এবং শত শত ক্রেস্ট। অতিথিদের একজন হিসেবে ক্রেস্ট বিতরণ আমারও দায়িত্ব। দাঁড়ালাম, ক্রেস্ট দিতে থাকলাম; কিন্তু শেষ আর হয় না। বাকি যে তিনজন অতিথি, তাঁরা বয়স্ক মানুষ, কিছুক্ষণ দিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে একে একে সটকে গেলেন। আমার বয়স বা শরীরের দোহাই দেওয়ার সুযোগ নেই। অতএব চলল। চলতেই থাকল। কিন্তু সেটা মূল গল্প নয়। গল্পটা অন্য। পুরস্কার দেওয়ার যজ্ঞ শেষে মাথা ঘুরছিল বলে বাইরে গিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিচ্ছি। শুনতে পেলাম পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজনের ক্ষোভের কথা। কথা শুনে বুঝলাম, ওঁরা প্রত্যেকে ভেবেছিলেন শুধু তাঁকেই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
কৌতূহলে ওই তরুণের কর্মকাণ্ড অনুসরণ করলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্রত্যেককেই ফোন করে এমনভাবে বলা হয় যে তিনি একাই পুরস্কারটা পাচ্ছেন। তাঁর জন্যই এই আয়োজন। তিনি সেজেগুজে এসে দেখেন পুরো বাজার। মনঃক্ষুণ্ন হন; কিন্তু আবার বলাও যায় না যে সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু আমাকে দাও। পুরস্কার নিতে হয়। হাসিমুখে পোজও দিতে হয়।
আর এভাবে পুরস্কার দিয়ে দিয়ে ছেলেটি শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অনেক নামি নায়ক-গায়কের সঙ্গে ওর এমন খাতির যে দেখে মনে হয়, কে বলে পুরস্কার শুধু পাওয়ার জিনিস। পুরস্কার আসলে দেওয়ারও জিনিস।
তাহলে শিক্ষাটা হচ্ছে এই যে, পুরস্কার নিতেও জানতে হয়! দিতেও জানতে হয়!
লেখক : মোস্তফা মামুন, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক