বৃটেনে এখন একটু একটু করে রাত লম্বা হতে শুরু করেছে। গরম সামান্য বেড়েছে। রোদের তেজ গত সপ্তাহের চেয়ে কিছুটা বেশি। সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকাল আরম্ভ হতে শুরু করেছে। এখানে সবচেয়ে মজার সময় এই গ্রীষ্মকাল। দু'মাস পর ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করলে এই মজা আর থাকবে না। বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে এ দেশে শীতকাল। শীতকালে ভীষণ ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে জনজীবন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।
গতকাল বিকেলে 'ক্যানন হিল পার্ক' ঘুরতে গিয়েছিলাম। বার্মিংহাম শহরের একেবারে কাছাকাছি জায়গায় পার্কটি অবস্থিত। পাশেই বার্মিংহাম এডবাস্টন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে যাবার দ্রুতগামী ট্রেনের নির্মিতব্য স্টেশনটিও একেবারে কাছে। এটির কাজ শেষ হলে বার্মিংহাম থেকে লন্ডন যেতে কিংবা লন্ডন থেকে বার্মিংহাম আসতে আগের চেয়ে অনেক কম সময় লাগবে। এর অনতিদূরে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল স্টেডিয়াম। ক্যানন হিল বেশ বড় একটি পার্ক। দৃষ্টিনন্দন এই পার্কে প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন ঘুরতে আসে। করোনার কারণে এখন লোক সমাগম আগের চেয়ে কম। পার্কটিতে সাঁতার কাটা ও খেলাধুলাসহ বিনোদনের নানা সুযোগ সুবিধা আছে। এর আয়তন কয়েকশ' একরের মত হবে। নানা বয়সী লোকজন এই পার্কে বেড়াতে আসেন। পার্কের ভেতরে চারদিকে হাঁটাচলা করার প্রশস্ত রাস্তা।
গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢোকার অবকাশ নেই। প্রবেশ ফি লাগে না। পার্কের ভেতর জায়গায় জায়গায় নানা জাতের গাছ। ছোট ছোট ফুলের বাগান। গলফ, ক্রিকেট ও টেবিল টেনিস খেলার সুন্দর ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও বুনো পরিবেশে নানা জাতের পাখির অবাধ বিচরণ। কেউ কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসেন। অনেকে আবার বন্ধু বান্ধব মিলে আসেন। দু'-চারজন একা একাও ঘুরতে আসেন। পার্কের ভেতর জায়গায় জায়গায় লেক আছে। বলাকা আকৃতির তরীতে লেকে ভেসে বেড়ানোর মজাই আলাদা। পুরো পার্ক জুড়ে গ্রামীণ পরিবেশের এক অতি সুন্দর আবহ।
ঈদুল আজহার আর মাত্র তিন-চার দিন বাকি। এখানে বৃটেনে ঈদ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। কাউকে দিনক্ষণ গণনা করতে শুনিনি। দেশে ঈদের মাস, দেড় মাস আগে থেকে ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে কোরবানির পশু কেনাবেচা নিয়ে অনেক মাতামাতি আর হৈ চৈ হয়। ঈদুল ফিতরের পর থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত ২ মাস ১০ দিন এক রকম হাতে গুণে গুণে শেষ হয়। হয়ত মুসলমানের দেশ নয় বলে এখানে ঈদ নিয়ে তেমন একটা বলাবলি নেই।
বার্মিংহামের যে এলাকায় আছি, সেখানে অনেকগুলো মসজিদ। প্রায় অলিতে গলিতে মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে বেশিরভাগ বাঙালি, ভারতীয় ও পাকিস্তানির বসবাস। প্রায় সবগুলো মসজিদ বাঙালি অথবা পাকিস্তানি মুসলমান দ্বারা পরিচালিত। গতদিন জুমার নামাজ পড়তে কাছাকাছি জায়গায় পাকিস্তানিদের পরিচালিত একটি মসজিদে গিয়েছিলাম। আজানের আগে ইমাম সাহেব কিছু সময় বয়ান পেশ করেন।
ঊর্দূ ভাষায় দেয়া বয়ানে তিনি মূলত: ঈদুল আজহা ও কোরবানির বিষয়ে আলোকপাত করেন। একটি বিষয় এখানের মসজিদগুলোতে লক্ষ্য করেছি। প্রায় প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের দু'টি জামাত হয়ে থাকে। আজান দিয়ে চার রাকাত সুন্নত পড়ে ইমাম সাহেব খুৎবা পাঠ শুরু করেন। অতঃপর দু' রাকাত ফরজ নামাজ পড়ে মোনাজাত শেষে অবশিষ্ট নামাজ বাসায় গিয়ে পড়ার কথা বলেন। দ্বিতীয় জামাতের জন্য মসজিদ খালি করে দেবার তাগদা- সেটি সহজে বুঝা যায়। মসজিদে সামাজিক দূরত্ব মেনে এবং স্বাস্থ্যবিধি পালন করে প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ আদায় করা হয়। নামাজের নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক একটু আগে মসজিদ খুলে দেয়া হয় এবং নামাজের পর পরই বন্ধ করে দেয়া হয়। মসজিদের প্রবেশ পথের দরজায় একটি টেবিলে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার রাখা থাকে। যে কেউ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। প্রায় সব মুসল্লি জায়নামাজ সাথে করে নিয়ে আসেন। যারা জায়নামাজ আনেন না, তাদের সেজদার জায়গায় দেবার জন্য বিশেষ সাইজের বড় বড় কাগজের পিস্ বাইরে টেবিলে রাখা থাকে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এক পিস কাগজ নিয়ে সেজদার জায়গায় রেখে তার উপর সেজদা দিতে হয়। নামাজ শেষে বাইরে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে তা ফেলে রেখে দিতে হয়।
খুব সম্ভবত বৃটেনের মুসলিম কমিউনিটির লোকজন ২০ জুলাই ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন। দেশে ২১ জুলাই উদযাপিত হবে বলে শুনেছি। জীবনে এই প্রথম দেশের বাইরে বিদেশের মাটিতে ঈদুল আজহা উদযাপন করবো। দুই বছর আগে একবার সৌদি আরবে ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছিলাম। নিজের দেশে ঈদ উদযাপন আর বিদেশের মাটিতে ঈদ উদযাপনে আনন্দের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান। সে কেবল আমাদের যারা প্রবাসে থাকেন, তারা এটি উপলব্ধি করে থাকেন।
এবারও দেশে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের সিঁকি আনা বোনাস দিয়েই ঈদ পালন করতে হবে। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমাদের দেশ ও জাতি উভয়ের জন্য একটি বড় লজ্জার বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে সিঁকি বোনাসের বিষয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। এবার এ নিয়ে তেমন কিছু লিখি নাই এ কারণে, ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে অন্তত আর কিছু না হোক শিক্ষক-কর্মচারীগণ ষোল আনা বোনাস পেয়ে যাবেন বলে আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছিল। জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকীর সম্মানে এটি তাদের দেয়া হবে বলে ভেবেছিলাম। আরেকটি কারণে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম। তিন-চার মাস আগে এমপিও নীতিমালা-২০১৮'র চুড়ান্ত সংশোধনী প্রকাশের পর শিক্ষক নেতাদের সরকারকে অভিনন্দন জানানোর হিড়িক দেখে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকেনি। বিশেষ করে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের নেতা শাহজাহান আলম সাজু ভাই যখন পুরো কৃতিত্বটুকু নিজে একা নেবার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন, তখন আর বিশ্বাস না করে যাই কোথায়? আমাদের দূর্ভাগ্য এই যে, মাত্র দু'টো লাইন বাংলায় একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লিখে দিলে এর অর্থ বুঝে উঠতে কষ্ট হয়। এমপিও নীতিমালা-২০১৮'র চুড়ান্ত সংশোধনীর যে অনুচ্ছেদে উৎসব ভাতার কথা উল্লেখ আছে, তাতে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সিঁকি বোনাসের কথাই বলা হয়েছে। সেটি না বুঝে যারা সরকারকে অভিনন্দন দেবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিলেন, তারা এখন সাধারণ শিক্ষকদের মুখ দেখাবেন কী করে ? এসব নেতার কারণে শিক্ষক সমাজ বার বার প্রতারিত হয়েছেন। ভবিষ্যতেও প্রতারিত হবার সমূহ আশংকা রয়েছে।
আরেকটি বিষয় আমার বোধগম্য হয়না। আমাদের দেশে এক সরকার ক্ষমতায় এসে অন্য সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম স্থগিত, বন্ধ কিংবা বাতিল করে দেয়। বরাবরই এটি হয়ে থাকে। কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের চার দলীয় জোট সরকার তথা বিএনপির দেয়া সিঁকি বোনাসটি কেন আজ পর্যন্ত এই সরকার পরিবর্তন করেনি, সেটি বুঝে উঠতে পারিনি। অন্তত ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে সেটি করে তারা শিক্ষক সমাজের হৃদয়ে আলাদা একটি জায়গা করে নিতে পারতেন। কেন সেটি করেননি, তা কেবল আল্লাহ মালিক ভালো করে জানেন। আমাদের আগের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো দেয়া, শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলে অন্তত শিক্ষক-কর্মচারীদের একটা আশার মধ্যে রাখতেন। যদিও তিনি শিক্ষকদের পাঁচগুণ (!) চিকিৎসা ভাতা ও দ্বিগুণ (!) বাড়িভাড়া করা ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারেননি। কিন্তু বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় শিক্ষকদের কোনদিন একটিও আশার বাণী শুনিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। শিক্ষকের মেয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে শিক্ষক সমাজ অনেক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন। এখন সবই গুঁড়ে বালির মতো হয়ে গেছে।
এখানে বৃটেনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাকালেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিন সব শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় না। পালাক্রমে একেক শ্রেণি, শাখা কিংবা গ্রুপের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দিনে ক্লাসে যেতে হয়। কোন একটি প্রতিষ্ঠানের কোন শ্রেণি, শাখা বা গ্রুপের একজন শিক্ষার্থী বা তার পরিবারে কেউ করোনা শনাক্ত হলে ঐ শ্রেণি, শাখা বা গ্রুপের শ্রেণি কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট অভিভাবককে বিষয়টি অবগত করা হয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম চলমান আছে। বিশেষ প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বশরীরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে থাকে। করোনা মহামারির শুরুর দিকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ এদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। ফলে আমাদের মত এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা করোনার কারণে এত বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। কেবল বৃটেন নয়, বাংলাদেশের মত ২০-২৫ টি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। বাংলাদেশের মত যে সকল দেশে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ আছে, তাদের বিষয়ে ইউনেস্কো ও ইউনিসেফ গত সপ্তাহে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার জন্য আর অপেক্ষা না করার পরামর্শ দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার কথা আমরা বহু আগে থেকে বলে আসছি। কিন্তু, কে শোনে কার কথা ? আল্লাহ না করুক, আরো ২-৪ বছর যদি করোনা থেকে যায় কিংবা আদৌ করোনা যদি নির্মুল না হয়, তাহলে কি বছরের পর বছর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এভাবে বন্ধ পড়ে থাকবে ? সবকিছু বাদ দিয়ে এ বিষয়টি নিয়ে এখনই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তা না হলে এক বছরে শিক্ষার যে ক্ষতি হবে, বিশ বছরেও তা পুষিয়ে উঠা কঠিন হবে।
নকল, নোট-গাইড আর কোচিং বাণিজ্য এমনিতে আমাদের শিক্ষাকে অর্ধ মৃত করে ফেলেছে। এখন করোনার যাঁতাকলে পড়ে আমাদের শিক্ষা
পুরোপুরি মরে যাক, সে আমাদের কাম্য নয়। যে করে হউক শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শিক্ষা না বাঁচলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। করোনাকে মেনে নিয়ে জীবন ও জীবিকার সাথে শিক্ষাকে চালিয়ে নেবার কৌশল বের করা এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।
বহুদিন পর বেশ কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে। এটি একটি ভালো খবর বটে। ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ থাকায় অনেকেই অন্যত্র নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। তারা চলে গেলে তাদের পদগুলো আবার শূন্য হয়ে যাবে। এতে কী লাভ হলো? শূন্য পদ পূরণ করতে গিয়ে নতুন শূন্য পদ তৈরির মানে বুঝতে পারি নি। পঞ্চাশ হাজার শূন্য পদ পূরণ করতে গিয়ে আরো পঁচিশ হাজার পদ খালি করা ঠিক হয় নাই। তারচেয়ে বদলির ব্যবস্থা চালু করাই উত্তম ছিল। তবু এনটিআরসিএকে ধন্যবাদ দেই। বহুদিন পরে হলেও তারা একটি বড়সড়ো নিয়োগের সুপারিশ করতে পেরেছে।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফররত।