পড়ার টেবিলে মন নেই - দৈনিকশিক্ষা

পড়ার টেবিলে মন নেই

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

করোনা মহামারি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পৃথিবী পুরোপুরি করোনামুক্ত হয়নি। কখন যে হবে, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কোনো কোনো দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও গত কয়েকদিনে সেই আশংকা তৈরি হয়েছে। এই কয়দিন থেকে করোনা সংক্রমণের হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। করোনার ধকল সইতে না সইতে আমাদের দেশে ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব শুরু হয়েছে। করোনা, বন্যা কিংবা যে কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগে অন্য যে কোনো সেক্টর অপেক্ষা শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির চরম শিকারে পরিণত হয়। দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের করোনায় আমাদের দেশে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থায় নানা নেতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজ এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে বসেছি।

আমার শিক্ষকতা জীবনের চার দশকে লেখাপড়ায় ছাত্রছাত্রীদের এত অমনযোগী হতে কোনোদিন দেখিনি। 'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ:' প্রবাদটি আজ নির্বাসনে যেতে বসেছে। ইদানিং স্কুল-কলেজে পড়ুয়া অনেক ছেলেমেয়ে বই নিয়ে বসার চেয়ে মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দিনরাত মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। গেইম খেলে, কার্টুন দেখে আরো কত কী? ইউটিউবে অশ্লীল ভিডিও দেখে দেখে এরা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলের ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির ওপর কেন জানি সরকার কিংবা অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। তা না হলে এরা এত নোংরা ও অশ্লীল চিত্র এবং ভিডিও কেমন করে আপলোড দেয় ? এসব চিত্র ও ভিডিও দেখলে মাথা-মগজ কারোর ঠিক থাকার কথা নয়। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী হবারই কথা। এ কোনো যমানায় এলুম রে বাবা ?

করোনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি এক অন্য ধরণের অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষকের প্রতি অনেক ছাত্র-ছাত্রীর আগের সে শ্রদ্ধা, ভক্তি, আবেগ কোনোটি নেই। বাড়ির কাজ রেডি করে ক্লাসে নিয়ে যাবার গরজ নেই। পড়াশোনায় আগ্রহ নেই। পরীক্ষা এলে এদের কোনো চিন্তা নেই। লেখাপড়ায় বাড়তি গরজ নেই। শিক্ষক নানা কারণে এখন বেকায়দায়। ছাত্র-ছাত্রীদের কথা শোনাতে পারেন না। এরা পিতামাতা এবং অভিভাবকের কথাও শুনতে চায় না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন তলানিতে। আগে এটি কতই না মধুর ছিল !

আজকাল শিক্ষক আগের মত ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করতে পারেন না। সাহস পান না। অভিভাবকেরাও কেমন যেন হয়ে গেছেন। শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের এক আধটু শাসন করলে তারা চটে যান। শিক্ষককে হুমকি ধামকি দেন। ভয় দেখান। মামলা মোকদ্দমার ভয়। স্কুল-কলেজে গিয়ে মুখের ওপর দু'চার কথা বলে আসতে একটু পরোয়া করেন না। শিক্ষকের শাসন এখন বারণ। আগে এরকম ছিল না। শাসন করলে মা-বাবা ও অভিভাবক শিক্ষককে ধন্যবাদ দিতেন। বেশি বেশি শাসন করার কথা বলতেন। শিক্ষককে বলতেন, 'শুধু হাড্ডিগুলো আমার, মাংস আপনার।' একথা বলে সন্তানের ওপর ষোলো আনা অধিকার খাটানোর এক অলিখিত অধিকার শিক্ষককে দিয়ে যেতেন। এখন বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের মুখে এসব কথা শোনা যায় না। বরং উল্টো কথা শিক্ষককে শুনতে হয়। এ কারণে আজকাল অনেক ছাত্র বেয়াদব টাইপের হয়ে যাচ্ছে। তারা শিক্ষক ও অভিভাবকে সামান্যই তোয়াক্কা করে। নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরা করে। মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা বড়দের থোড়াই কেয়ার করে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা অন্য রকম হয়ে গেছে। মনে হয়, মানসিক দিক থেকে এরা অনেকটা বিপর্যস্ত। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই। বহুদিন থেকে স্কুল-কলেজে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের কথা শুনে আসছি। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যে অবক্ষয় হয়েছে, তার জন্য মনোবিজ্ঞানী দ্বারা কাউন্সিলিং করা হলে অনেকটা পুনরুদ্ধার করা যেত। অভিভাবক ও শিক্ষক মিলে তাদের মানসিক অবস্থা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া যেত। সকলে যেন দায়সারা হয়ে পড়েছেন। সরকার এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবার এবং অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। কিন্তু কার গোয়াল, কে দেয় ধোঁয়া? শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি নানা কারণে আগ্রহ এখন শূন্যের কোঠায়। করোনার আগে যেটুকু ছিল, এখন সেটুকুও নেই। করোনার সময় অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে এরা স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ফ্রি লাইসেন্স পেয়ে গেছে। এখন তাদের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেবার সাহস কারো নেই। না বাবা-মায়ের, না শিক্ষকের। এমন অবস্থায় মোবাইল এখন তাদের গলার তাবিজ হয়ে গেছে। মোবাইল দেখে দেখে তারা ঘুমাতে যায়। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ না ধুয়েই মোবাইল নিয়ে বসে পড়ে। যাবার সময় মোবাইল দেখে দেখে প্রতিষ্ঠানে যায়। আসার সময় দেখে দেখে বাড়ি ফেরে। সুযোগ পেলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি ওঠায়। নেটে ছেড়ে দেয়। টিকটকের নামে কত যে ঢং তামাশা করে, তার হিসেব নেই। মোবাইল বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বটে। অভিশাপও কম নয়। এটি আমাদের বহু ঐতিহ্য কেড়ে নিয়েছে। ঘড়ি, ক্যামেরা, ক্যালকুলেটর, রেডিও, টিভি কত কিছুর ব্যবহার আজ সীমিত হয়ে পড়েছে। মোবাইল এদের সরিয়ে দিয়ে এসবের কাজ নিজে করে দেয়। ঠিক তেমনি মোবাইলের কারণে আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা, আদব কায়দা কত কিছু গোল্লায় গেছে। এর কারণে আজকালের ছেলেপিলেরা অকালপক্ক হয়ে উঠছে। এদের সাথে কেউ এখন পেরে উঠতে পারে না। না শিক্ষক, না অভিভাবক। শিক্ষক ও অভিভাবক অনেক ক্ষেত্রে এদের কাছে জিম্মি। ইচ্ছেমত নানা ফ্যাশনের চুল তাদের মাথায়। শিক্ষকের শত নিষেধ গায়ে লাগে না। মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেতাই করে। স্কুলের নাম করে বাড়তি টাকা নেয়। টাকা দিয়ে ডাটা কেনে। মোবাইল চালায়। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা ইয়ার্কি মারে। যখন ইচ্ছে রাতে বাড়ি ফেরে। এদের গায়ে ছাত্রের কোনো নাম-গন্ধ নেই। করোনার কারণে গত দুই বছর পরীক্ষা ছাড়া অটোপাস পাওয়ায় এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পড়াশোনা না করে, পরীক্ষা না দিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠতে পেরে এখন তারা মনে করে পড়াশোনা কিংবা পরীক্ষার কী দরকার ? তাদের মাঝে এক রকম মাস্তানি মাস্তানি ভাব।

করোনার সময় দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ইদানিং শিক্ষার্থীদের আচরণে অপ্রত্যাশিত কিছু আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী নির্ধারিত ড্রেস পরে ক্লাসে আসে না। দৈনন্দিন সমাবেশে তেমন আগ্রহ নেই। সহপাঠীর সাথে আগের সখ্য নেই। অনেকে বই, খাতা, কলম নিয়ে ক্লাসে আসে না। শিক্ষককে থোড়াই কেয়ার করে। পোশাকে-আশাকে, চুলে-গোঁফে এদের ছাত্র মনে হয় না। চাল চলনে, কথা বার্তায় ছাত্রের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। পরীক্ষায় নকলপ্রবণতার দিকে অনেকের ঝোঁক।

করোনার শুরুতে যারা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত, এখন তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে। যারা অষ্টমে ছিল, তারা এখন দশমে। যারা একাদশে ছিল, তারা ডিগ্রি কিংবা অনার্সে। করোনার কারণে অটোপাস পাওয়ায় তাদের এক অন্য রকম বেটাগিরি। এই বেটাগিরি ভাব তাদের ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছে। এদের নিয়ে পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকেরা দারুণ উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠায়। তাদের নিয়ে নতুন করে শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার সকলকে চিন্তা ভাবনা শুরু করতে হবে। তা না হলে আগামী একটি প্রজন্ম গোল্লায় যাবার সমূহ আশংকা।

 
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003216028213501