আজ মার্চ ১৪, আন্তর্জাতিক গণিত দিবস (International Day of Mathematics)। ইতিহাসের নানা ঘটনার পরিক্রমায় আজকের দিনটি বিজ্ঞানী, গবেষকসহ বিভিন্ন মহলের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
গণিতবিদ, পদার্থবিদসহ যেকোনো বিজ্ঞানীর কাছে গ্রিক অক্ষর π (পাই) খুবই পরিচিত। এটি একটি রহস্যময় গাণিতিক ধ্রুবক, যা অনেক জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়। এর মান প্রায় ৩.১৪১৫৯২৬..., যা কি না একটি বৃত্তের পরিধির সঙ্গে এর ব্যাসের অনুপাত এবং এটি একটি ধ্রুব সংখ্যা। গণিতে এটিকে অমূলদ সংখ্যা বলা হয়। ১৪ মার্চকে USA স্টাইলে লেখা হয় ৩.১৪ (৩/১৪ মাস/দিন হিসেবে), যা পাই এর প্রথম তিনটি ডিজিটের সঙ্গে মিলে যায়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজকের এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক পাই দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। শনিবার (১৪ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সভ্যতার ইতিহাসে গণিতের অবস্থান অনেক প্রাচীন। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে নানা কাজে এটিকে ব্যবহার করলেও সাবজেক্ট হিসেবে গণিতের জন্ম হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে, অর্থাৎ পিথাগোরিয়ানদের সময়ে। Mathematics (গণিত) শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Mathema থেকে, যার অর্থ Subject of Instruction. আমরা সবাই জানি যুগ যুগ ধরে গণিত মানুষকে বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান দিয়ে আসছে। মানুষের জীবনে এর ব্যবহার ও প্রয়োগ দিন দিন অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। সর্বসাধারণের কাছে গণিতের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার প্রয়াসে আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়ন (IMU) আজকের এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ইউনেসকোকে দাবি জানায়। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ২৬ নভেম্বর ২০১৯ সালে, ইউনেসকো তার ৪০তম সম্মেলন ১৪ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথমবারের মতো এই বছরই দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
গণিতের উৎপত্তি হয়েছে মানুষের ব্যাবহারিক জীবনের নানা জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য। সচরাচর মানুষ যেসব সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম, সেসব সমস্যা গণিতের সহায়তায় খুব সহজেই সমাধান করতে পারে। সে কারণেই গণিতকে Mother of Science অর্থাৎ বিজ্ঞানের জননী বলা হয়। আমাদের শিক্ষার অন্যান্য শাখা-প্রশাখা এবং বাস্তব সমস্যা সমাধানে গণিতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। একসময় আমরা শুনতাম মানবিক, বাণিজ্য বিভাগসহ চিকিৎসা, জীব কিংবা কৃষিবিজ্ঞানে গণিতের ব্যবহার নগণ্য; কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে শিক্ষার এসব বিভাগেও গণিত অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এসব সেক্টরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে।
এখন আসা যাক আমার দেশের প্রসঙ্গে। গণিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এর গুরুত্ব আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এখনো অনেক কম। ওদের কাছে এই বিষয়টি হচ্ছে একটি কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়। যেখানে গণিতের প্রয়োগ করে বাস্তব সমস্যার সমাধান করার কথা, উল্টো মনে হচ্ছে গণিত নিজেই একটা বাস্তব সমস্যা। বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এ কথা বিশ্বাস করে না যে এটা একটা সহজ ও মজাদার বিষয়। গণিত একটি মজাদার বিষয়—এ কথা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হবে। এর জন্য আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ী করে লাভ নেই। এর জন্য দায়ী আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের কিছুটা অবহেলাও রয়েছে।
গণিত নিজেই একটি ভাষা। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো এই ভাষাটিও শিখতে হবে যদি কেউ আমরা এর প্রয়োগ করতে চাই বাস্তব জীবনে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ছোটবেলা থেকে আমাদের সেইভাবে গণিত শেখানো হয় না। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণপণ চেষ্টা থাকে গণিত শিক্ষার জন্য। আজকাল খুব কম ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা গণিত শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টার কিংবা গৃহশিক্ষকের কাছে যায় না। কিংবা মা-বাবাসহ অভিভাবকেরও প্রচেষ্টায় কোনো ত্রুটি থাকে না তার ছেলে-মেয়ে কিভাবে গণিত শিখবে। এখন একবার ভেবে দেখুন এটি শেখার কৌশল কী ছিল। সাধারণত গণিত বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় থেকে কিছু সমস্যা কিভাবে সহজে সমাধান করা যায় তা ছিল আমাদের গণিত শেখানোর পদ্ধতি। এটা কোনো ভাষা শিক্ষার কৌশল হতে পারে না। এই কথাটায় মনে হয় আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন। তাই গতানুগতিক পদ্ধতিতে ছাত্র-ছাত্রীরা গণিতে ভালো নম্বর পেলেও দেখা যায় উচ্চশিক্ষায় কিংবা বাস্তব ক্ষেত্রে গণিতের প্রয়োগের দিক থেকে ওরা দুর্বল থেকে যাচ্ছে।
অনার্স, মাস্টার্সসহ উচ্চশিক্ষার সব প্রগ্রামে গণিতের কিছ বেসিক কোর্স যেমন ক্যালকুলাস, লিনিয়ার অ্যালজেবরা, পরিসংখ্যানসহ আরো অনেক বিষয় পড়ানো হয়। এই কোর্সগুলো সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তির কারণ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নিজস্ব প্রগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য গণিতের নানা ফর্মুলা প্রয়োগ করতে পারে। উচ্চশিক্ষায় বিদেশি পাঠ্যক্রমেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।
আমাদের দেশে অনেক ছাত্র-ছাত্রী গণিত কম বোঝার কারণে স্কুল কিংবা কলেজে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে মানবিক বা কমার্স নিয়ে পড়াশোনা করে। কিংবা অনেকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও গণিতকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নিয়ে থাকে। সেসব ছাত্র-ছাত্রী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন তাদের গণিতের বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়। যখন তারা গাণিতিক বিষয়টি বুঝতে অক্ষম হয় তখন শিক্ষকরা দোষ চাপিয়ে দেন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর। কিন্তু এর জন্য কি শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই দায়ী?
গণিতের মতো এত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন ঐচ্ছিক, যেখানে উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরেই গণিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ!
আর একটি অপূর্ণতা হচ্ছে গণিতের ভাষা বোঝার জন্য আমাদের স্কুল কিংবা কলেজ লেভেলের পাঠ্যপুস্তক বা বর্তমান সিলেবাস যথেষ্ট নয়। এর বাইরে আমি দায়ী করব আমাদের শিক্ষকদের একাংশকে, বিশেষ কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা পড়ানোর বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নন। ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু Formula শিখিয়ে আর বিশেষ কিছু সমস্যার সমাধান করে দিলেই গণিতের মতো বিষয় ওরা অনুধাবন করতে পারবে না। বাস্তব জীবনে গণিতের প্রয়োগ করার মতো দক্ষ হতে হলে ছাত্র-ছাত্রী বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। আমরা অনেক সময় দেখি একজন ছাত্র বা ছাত্রী গণিতে খুবই ভালো। অর্থাৎ সে Formula জানে এবং তা প্রয়োগ করে কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে। তার মানে এই না সে বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে।
বিশেষ কিছু গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার কৌশল না শিখিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কিভাবে একটা নির্দিষ্ট বিষয় অনুধাবন করতে পারে এবং তা দিয়ে নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে পারে সেভাবে গণিত শেখানো উচিত। তাহলে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা গণিতে ভয় না পেয়ে শিখতে আগ্রহী হবে। আমাদের দেশের উন্নয়নের একমাত্র পথ হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি। তথ্য, যোগাযোগ, শিল্প, কৃষি ও চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের বর্তমান সরকারের লক্ষ্যও তাই। এই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এবং দেশকে প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে আমাদের তরুণ সমাজকে গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ওদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ওরা প্রযুক্তির ভাষা গণিতের মাধ্যমে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আজ এই কাজে সরকারসহ অভিভাবক, শিক্ষক ও সব সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আজকের বিশ্ব গণিত দিবসের উদ্দেশ্য সফল ও সার্থক হবে।
লেখক : ড. মোহাম্মদ মনির উদ্দিন, সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।