আত্মসমালোচনা হলো নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। ইংরেজিতে একে self-criticism বা self-accountability বলা হয়। আত্মসমালোচনা বলতে বোঝায় সচেতনভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা। যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। আত্মসমালোচনা শুধু ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে সমালোচনা করবে এমনটিও নয়; বরং নিজের পরিবার, সমাজ ও স্বজাতি কিংবা স্বদেশ নিয়েও হতে পারে আত্মসমালোচনা। রোববার (২৭ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
ময়লাযুক্ত চেহারার কোনো মানুষ যদি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, লোকটির চেহারার কোন পাশে কোন দাগ কেমন দেখাচ্ছে, তা ফুটিয়ে তুলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আত্মসমালোচনাও দর্পণের মতো ব্যক্তির ভুলভ্রান্তিগুলোকে ফুটিয়ে তোলে এবং নিজেকে সুধরানোর সিদ্ধান্ত তৈরি করে দেয়।
এই বিশ্বলোকে কোনো মানুষই ত্রুটিবিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নয়। যেহেতু অনেক মানুষের সামষ্টিক পরিচয় বহন করে ‘জাতি’ শব্দটি দ্বারা, সেহেতু কোনো জাতিও দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে হতে পারে না। ভুল কিংবা অপরাধ করলে কোনো জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যায় না। বিরাট ক্ষতি তখনই হয়, যখন অপরাধকে অপরাধ মনে না করে, একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটার পেছনে আত্মসমালোচনার অভাবই হলো মুখ্য কারণ। বিশেষত জাতির নেতৃস্থানীয়দের থেকে অপরাধের সূচনা হয় যখন, ঠিক তখনই জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনায় ধস নেমে আসে। এতে করে সাধারণ জনগণের সবচেয়ে কঠিন ভোগান্তির মধ্যে থাকতে হয় এবং স্বজাতীয় সম্পদের উন্নতির চেয়েও অধঃপতিত হয় বেশি।
জাতীয় সমস্যার সবচেয়ে নিদারুণ সমালোচনা করতে পারেন উক্ত জাতির লেখক ও সাহিত্যিকবর্গ। লেখকগণ লেখনীশিল্পের মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাসহ শাসকশ্রেণিকে সংশোধনবার্তা স্ফুলিঙ্গের মতো পরিষ্কার করে দিতে পারেন। অন্যদিকে শাসক শ্রেণি যদি সমালোচনাসহিষ্ণু হয়, তাতে জাতির ভাগ্যে সুপ্রসন্ন্নতা নিশ্চিত।
অন্যথায় শাসক শ্রেণি যদি সমালোচনাসহিষ্ণু না হয়, তখন স্বজাতীর অনাগত ভবিষ্যত্ হুমকির মুখে দাঁড়ায় এবং জাতীয় অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। প্রতিনিয়ত ব্যক্তিস্বাধীনতাও খর্ব হতে থাকে। জাতি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর খুব নামডাক যদিও আমরা করি, তবে এটি সত্য যে তাদের দেশের শাসকবর্গ কেমন তা জানার চেষ্টা খুব কমই করে থাকি। সেই দেশগুলোর শাসকশ্রেণি রীতিমতো অত্যন্ত সমালোচনাসহিষ্ণু। সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে সরকারপ্রধানও ক্ষমতা থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়েছে এরকম নজির অসংখ্য।
লেখকবর্গেরও অবাধ স্বাধীনতা আছে স্বজাতীয় সমস্যাগুলো সবার কাছে বার্তা হিসেবে পৌঁছে দেওয়ার। জাতীর আত্মসমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী! রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’ তিনি বাঙালিদের কোন অশুভ দিকটি ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন তা আমার প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। প্রসঙ্গত বিষয় হলো, তিনিও আত্মসমালোচনা করেছেন নিজের জাতিকে শোধরানোর উদ্দেশ্যে, যা থেকে বাঙালি এখনো শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের শোধরাতে পারবে।
১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর আত্মসমালোচনা সম্পর্কিত অমিয় বাণীটি সাম্প্রতিককালের বাঙালিদের আমলে আনা উচিত। দেশ ও স্বজাতির উন্নতির লক্ষ্যে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া-কথায় চলে না দেশ। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাদের বলেছিলাম আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চিনতে পারবে না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবে।’ স্বাধীনতার মহান স্থপতির এই বাণীর মর্মার্থ হলো, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মপরিচয় আবিষ্কার করা যায়। নিজেকে চেনার ফলে দেশ ও স্বজাতিকে নির্মাণ করা যাবে।
নিজের দোষের বিষয়ে কোনো জাতি যতদিন অন্ধ থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সুগুণের আলো পলাতক থাকবে। সুতরাং আত্মসমালোচনা দেশ বা জাতির জন্য বয়ে আনতে পারে উন্নতির সোনালি পায়রা।
লেখক: ফায়াজ শাহেদ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়