আসলেই আমি ঘটনাচক্রে শিক্ষক - দৈনিকশিক্ষা

আসলেই আমি ঘটনাচক্রে শিক্ষক

মো. রহমত উল্লাহ্ |

শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কিছু উক্তি নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষক সমাজে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একটা বড় অংশ, ঘটনাচক্রে শিক্ষক। অন্য কোনো পেশায় অনেকেই যেতে পারেননি, শিক্ষকতা কোনোদিন তারা চাননি। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, তার জীবনের লক্ষ্যই হবে শিক্ষকতা পেশা।  তিনি সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসবেন।’ [দৈনিক শিক্ষা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১]

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত শিক্ষকদের বিভিন্ন মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের এসব কথায় খুবই কষ্ট পেয়েছেন তারা। তিনি অবশ্য সবাইকে 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' বলেননি; শিক্ষকদের বড় একটা অংশকে 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' বলেছেন। সকল শিক্ষক ভাই ভাই। সুতরাং শিক্ষকদের বড় একটা অংশকে এমন কথা বললে সবাই কষ্ট পাবেন এটাই স্বাভাবিক। আমিও কষ্ট পেয়েছি। তবে সে কষ্টের কারণ সবার সঙ্গে নাও মিলতে পারে।

অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, আমি খুব ভাল ছাত্র ছিলাম, আমি অনেক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষক হয়েছি, আমি অনেকভাবেই অনেক যোগ্য। সুতরাং আমি 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' হইনি। তাই শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের এই কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি! হ্যাঁ, একজন যোগ্য মানুষ যদি মনে করেন তাকে অযোগ্য বলা হয়েছে তো তিনি কষ্ট পাবেন এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমি তত যোগ্য মানুষ নই। তাই তেমন চিন্তা আমি করতে পারিনি। তেমন ভেবে আমি কষ্ট পাইনি। কেননা, আমি আসলেই 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' হয়েছি। যিনি সুযোগ পেয়েও অধিক বেতনের চাকরিতে না গিয়ে কিংবা অন্য পেশায় না গিয়ে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা করবেন বলে স্বেচ্ছায় এদেশের বেসরকারি শিক্ষক হয়েছেন, তিনি অবশ্যই আমার চেয়ে উত্তম। যদিও আমি জানি না, আসলে এমন আছেন ক'জন! 

বিভিন্ন বাস্তব কারণে এর চেয়ে বেশি উপার্জনক্ষম কোন পেশা অর্জন করতে পারিনি বলেই আমি বেসরকারি শিক্ষকতায় এসেছি। যতই যুক্তিযুক্ত হোক সেসব কারণ, অন্য পেশা অর্জনে আমি ব্যর্থ হয়েছি এটিই শেষ কথা। তবে শিক্ষকতায় এসে আমি আর অনিহা দেখাইনি, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করিনি, কোন কাজে ফাঁকি দিইনি, শিক্ষার্থীদের ঠকাইনি। লেখাপড়া করেছি, প্রশিক্ষণ নিয়েছি, শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছি। মনেপ্রাণে শিক্ষক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি ও করছি। বেতন-ভাতা কম পাই বলে কখনো কাজ কম করার চিন্তা করিনি। হয়েছি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান। এতোকিছুর পরেও এটাই সত্য যে, আমি শিক্ষক হতে চাইনি, অন্য কোনো পেশায় যেতে পারিনি, তাই ঘটনাচক্রে বেসরকারি শিক্ষক হয়েছি। আমার মতো আরও অনেকেই আছেন। শুধু বেসরকারি নয়, যারা সরকারি শিক্ষক হয়েছেন তাদের অনেকেরই এটি ফার্স্ট চয়েজ ছিল না। অন্যান্য ক্যাডারে এবং পেশাতেও এমন উদাহরণ আছে। এটাই বাস্তব সত্য। এই সত্যটা স্বীকার করার সৎসাহস নেই আমাদের অনেকেরই। আমরা স্বীকার করি বা না করি, এই সত্যটাই স্বীকার করেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। তিনি পরিস্কার করেই বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একটা বড় অংশ, ঘটনাচক্রে শিক্ষক। অন্য কোনো পেশায় অনেকেই যেতে পারেননি, শিক্ষকতা কোনোদিন তারা চাননি। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন।’ 

আমাদের দেশের বাস্তবতাটি উপলব্ধি করার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ। 

কিন্তু যুগ যুগ ধরে অধিক যোগ্যরা শিক্ষকতায় না আসার দায় কার? আমরা কেন যুগ যুগ ধরে ঘটনাচক্রে শিক্ষক হলাম? আমরা কেন স্বেচ্ছায় শিক্ষক হতে চাইনি? আমরা কেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় থাকতে চাই না? আমাদের চেয়ে অধিক যোগ্যরা কেন স্বেচ্ছায় শিক্ষক হলেন না? আমাদের অধিক যোগ্য সন্তানটি কেন স্বেচ্ছায় শিক্ষকতায় আসতে চায় না? অধিক যোগ্যদের লক্ষ্য কেন শিক্ষকতা নয়? আমরা কেন শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য পেশায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছি? কেন শিক্ষকতায় পূর্ণ শ্রম, সময়, মেধা ও মনোযোগ দিতে পারছি না? অনেকেই কেন এখনও যথাযথ প্রশিক্ষণবিহীন রয়ে গেছি? 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' দিয়ে কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব আসন্ন আধুনিক শিক্ষাক্রম? কতটুকু সম্ভব বিশ্বমানের নাগরিক-কর্মী তৈরি? আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সেচ্ছায় না হয়ে কেন 'ঘটনাচক্রে শিক্ষক' হচ্ছেন প্রায় শতভাগ শিক্ষক? এখানেই তো আমার কষ্ট! অতীত ও বর্তমান কোনো সরকার কি এড়াতে পারে এই দায়?


লেখক : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063018798828125