সাধারণ মানুষের তথ্য জানতে চাওয়া এ যেন এখনও অলীক কল্পনামাত্র। তথ্য জানার অধিকার নাগরিক মাত্রই আছে, এ হলো কাগজে-কলমের কথা। অত বড় প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ সেই হার মানে, আমরা কোন ছার। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে গুমের তথ্য চেয়ে গত নয় বছরে জাতিসংঘ দশ দশটি চিঠি পাঠিয়েছে; জবাব পায়নি। তাগাদা দিয়েছে, অসন্তোষ প্রকাশ করেছে; কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি (কালের কণ্ঠ, ২৯ আগস্ট, ২০১৯)। শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, এসব বড় বড় ব্যাপারে নাক না হয় না-ই গলালাম; কিন্তু ছোট ব্যাপারগুলোও তো ভীষণ ভয়াবহ। এই যে ডেঙ্গু, তার আতঙ্কে তো লোকে কোথাও স্থির থাকতে পারছে না। না ঘরে না বাইরে। ওদিকে শোনা যাচ্ছে ডেঙ্গু থাকবে, 'ইট হ্যাজ কাম টু স্টে'। 'পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে' বলে একদা ঘোষণা দিয়েছিলেন 'জাতির পিতা' কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অতি ভয়ঙ্কর সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে ৩০ লাখ ভাইবোন; এখন 'ডেঙ্গু হ্যাজ কাম টু স্টে'কে মিথ্যা প্রমাণ করতে না জানি কত মূল্য দিতে হবে। আমাদের বুক কাঁপে। নিজেদের যতই বীরের জাত বলি না কেন, মার খেয়ে খেয়ে ইতিমধ্যে আমরা বেশ ভীতু হয়ে পড়েছি, সন্ত্রস্ত থাকি। সর্বত্র সন্ত্রাসীদের দেখতে পাই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে হাজির হলে নিশ্চিন্ত হওয়ার পরিবর্তে দুশ্চিন্তাগ্রস্তই হই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত যে কোনো একদিনের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে আমাদের ভয় বাড়ে। রক্ত লাফালাফি করে। একদিনের- ১. কর্মসংস্থান বাড়ছে না; বছরে বেকার হচ্ছে ৮ লাখ মানুষ; ২. প্রধানমন্ত্রী এলজিআরডিতে বলেছেন, চাষযোগ্য জমি রক্ষার মাস্টারপ্ল্যান করুন; ৩. গরুর দুধেও বিষের ভয়; ৪. হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বসে আছেন অসহায় মানুষ, জামিনের আশায়; তারা জানেন না মামলা কেন, কোন অভিযোগে; ৫. একজনকে তিন দিন আগে আটক করে ভুয়া পুলিশ নয় খাঁটি পুলিশই ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে; ৬. মধ্যবিত্তের আবাসন এখনও অধরা; ৭. ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষা নিজ বাসায় খুন হয়েছেন; সন্দেহ দুই কাজের মেয়েকে; ৮. হাওরে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি; ৩৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট; ৯. ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহে যুবককে পিটিয়ে মারলেন এসআই; ১০. দূরপাল্লার বাসকর্মীর বক্তব্য : চাঁদা দেই, সেটা যাত্রীদের ওপর থেকে তুলে নিই; ১১. অপহরণকারীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্য; ১২. সাটুরিয়ায় পাওনা টাকা চাইতে থানায় গেছে এক তরুণী। দুইদিন আটকে রেখে, ইয়াবা খাইয়ে, দুইজন পুলিশ মিলেমিশে তাকে ধর্ষণ করেছে; ১৩. শেরপুরে নয় মাসেও উদ্ধার হয়নি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ফজলু মিয়া। এই কিছুদিন হলো অন্য একটি দৈনিকে খবরের শিরোনাম দেখলাম- 'তুলে নিয়ে কিশোরীকে ৮ দিন ধরে ধর্ষণ করেছে ছাত্রলীগের নেতারা'। এর বেশি পড়তে সাহস হলো না, রুচিতেও কুলালো না। তবে ওই খবরের ঠিক নিচে দ্বিতীয় শিরোনামে আরেকটি খবর তো চোখে পড়বেই, পড়লও; ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় স্বামীর শরীরে এসিড নিক্ষেপ (ভোরের কাগজ, ২৮ আগস্ট, ২০১৯)।
কে কাকে নিরাপত্তা দেবে? মানুষ কোথায় নিরাপদ? ডেঙ্গুর মশারা নাকি ঘরেই বেশি তৎপর হয়। তাই বলে তারা যে বাইরে নেই, তাও নয়। আছে। কেবল মশা নয়; ট্রাক, বাস, মোটরগাড়ি, সবকিছু আছে, আছে বায়ুদূষণ। মানুষ মারার ও তাদের চলাচল অচল করে দেওয়ার জন্য সমস্ত কিছুর আয়োজন সদাপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে, ইশারার অপেক্ষা। কৃষ্ণা রায় চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজধানীর বাংলামটরের কাছে, রাস্তা পার হয়ে অফিসে যাবেন বলে। পারলেন না, একটি বাস এসে ধাক্কা দিয়ে তার একটি পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। বাস কোম্পানি নাকি তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকা সেধেছে। কৃষ্ণা রায় চৌধুরী সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন- টাকা চাই না, বিচার চাই। আমরাও আশা করব, তিনি বিচার পাবেন; কিন্তু পাবেন কি? আমরা মোটেই নিশ্চিন্ত নই। রাজশাহীর লাঞ্ছিত সেই মেয়েটি তো সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, বিচার সে পাবে না। ফেসবুকে সে কথাটাই সে জানিয়েছে তার আপনজনকে। লিখেছে, 'এটা বাংলাদেশ, কোনো বিচারের আশা আমি করছি না।' বাংলাদেশে বিচার পাওয়ার আশা নেই, এটা কোনো দৈবজ্ঞান নয়; ভুক্তভোগীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বটে। মেয়েটির লাঞ্ছনার ঘটনা আগস্ট মাসের ১৯ তারিখের; অটোরিকশায় চেপে সে যাচ্ছিল রাজশাহী প্রকৌশল বিদ্যালয়ে। ক্লাস করবে। অটোতে আরও যাত্রী ছিলেন, কিছুদূর যাওয়ার পর চালক অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দিয়েছে; বলেছে, 'আমার লোকেরা যাবে।' চারজন বখাটে উঠল এবং মেয়েটিকে হয়রানি করা শুরু করল। মেয়েটি বাধা দিয়েছে, চিৎকার করেছে। কাজ হয়নি। ভাগ্য ভালো, এক জায়গায় পাবলিকের ভিড় দেখা গেছে, তখন বিপদ বুঝে বখাটেরা ছাত্রীটিকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে অটো নিয়ে পালিয়ে গেছে। পাবলিকের হাতে ধরা পড়লে অবশ্য অন্য ব্যাপার ঘটত। পাবলিক বখাটেদের মেরেই ফেলত। এ রকমটা এখন হামেশাই ঘটছে। পাবলিক এখন ভীষণ ক্ষিপ্ত। পুলিশকে একদম বিশ্বাস করে না এবং অপরাধীকে ধরতে পারলে নিজেরাই বিচার করে অর্থাৎ মেরে ফেলে পিটিয়ে। যেমন এই খবরটা, 'ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টায় বাধাদান, প্রাণ গেল মামার। গণপিটুনিতে নিহত বখাটে' (যুগান্তর, ২০ আগস্ট, ২০১৯)।
বাধা দিতে গেলে প্রাণ যায় আর পাবলিক যদি একবার পাকড়াও করতে পারে তবে ছাড়ে না, প্রাণ কেড়ে নেয়। মিডিয়া বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পঞ্চাশের অধিক ব্যক্তি গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে মিথ্যা গুজবে নিষ্ঠুর হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কিছুদিন আগে ঢাকা শহরের বাড্ডা এলাকাতে তসলিমা বেগম রেণু নামে এক মা তার ছোট্ট মেয়েটিকে ঘরে রেখে কোন স্কুলে তাকে ভর্তি করা যায়, সেটা খুঁজতে বের হয়েছিলেন; এক স্কুলে অপেক্ষমাণ মাদের মধ্যে কে একজনের সন্দেহ হয়েছে, এই নারী বুঝি ছেলেধরা, অমনি মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে খবর এবং নারীটিকে মেরেই ফেলা হয়েছে গণপিটুনিতে। আসলে কারও প্রতি কারও আস্থা নেই, সবাই সবাইকে শত্রু ভাবে। নরক যদি কোথাও থাকে, তবে সেটা থাকে এ রকমের আস্থাহীনতা, শত্রুতা ও পরস্পর বিচ্ছিন্নতার ভেতরেই। আমরা ওই রকম অবস্থার দিকেই দ্রুত ধাবিত হচ্ছি, নাকি পৌঁছে গেছি ইতিমধ্যে? বিচার পাবেন কি সেই মেয়েটি, সনজীদা ইয়াসমিন সাধনা নাম, শেরপুরের বাসিন্দা, যার ওপর তার অফিসের বড় সাহেব চড়াও হয়েছিলেন? মেয়েটি পিয়নের চাকরি করেন, ডিসি সাহেব তাকে তার অফিসে চাকরি দিয়েছিলেন। মেয়েটি ভেবেছিলেন, তিনি দয়ার সাগর। পরে দেখেছেন ভয়ঙ্কর মূর্তি ওই কর্তার। ডিসি অফিসের খাস কামরাতেই ডিসি সাহেব সাধনার ওপর চড়াও হয়েছেন। সেই ছবি ছড়িয়ে গেছে সামাজিকমাধ্যমে। ডিসি ধরা পড়েছেন। তার শাস্তি হবে। কী শাস্তি? চরম শাস্তিও যদি হয়, তাহলে বড়জোর পদচ্যুতি। আর মেয়েটির? একদিন অনুপস্থিত থেকে মেয়েটি অফিসে এসেছিলেন। সাংবাদিকরা তক্কেতক্কে ছিলেন, একেবারে ছেঁকে ধরেছেন। পত্রিকার রিপোর্টে পড়লাম, 'কাকুতিভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার বাঁচার কোনো ইচ্ছা নেই। আমার একটি এতিম সন্তান রয়েছে, আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে আমাকে এভাবে ধিক্কার না দিয়ে আমার এতিম সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে বাঁচার ব্যবস্থা করে দেন।' ওদিকে ডিসি অফিসের সব কর্মচারী একত্র হয়ে ভারপ্রাপ্ত ডিসির কাছে গিয়ে বলেছেন, ওই নারী কাজে যোগ দিলে তারা কাজ করবেন না। নারী তখন ওয়েটিং রুমে অপেক্ষায় ছিলেন; কথাবার্তা সব শুনেছেন, শুনে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। পরে সহকর্মীদের সহায়তায় জ্ঞান ফিরে পেলে তিন দিনের ছুটির দরখাস্ত জমা দিয়ে তিনি অফিস ত্যাগ করেন (ভোরের কাগজ, ২৭ আগস্ট, ২০১৯)। বোঝাই যাচ্ছে তার চাকরি তো শেষই, জীবনও সম্ভবত শেষ। অপরাধ কার, কে শাস্তি পায়। শাবাশ বাংলাদেশ!
সমাজে নানারকম অসঙ্গতি যেমন বিদ্যমান, তেমনি অসঙ্গতিগুলো দূর করার প্রচেষ্টাও ম্রিয়মাণ। যে কোনো সমাজেই সমস্যা আছে, থাকবেও; কিন্তু এর নিরসনের উদ্যোগ তো থাকা চাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা এ রকম প্রচেষ্টার উদ্যোগ দেখতে পাই এবং তাদের সদিচ্ছা কিংবা আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই বিধায় তারা সমস্যামুক্ত হতে পারছে, এগিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু আমাদের এখানেও এসব ব্যাপারে কথাবার্তা হয় বটে; কিন্তু প্রায় সবই যেন থাকে ওই আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের গণ্ডিবদ্ধ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক।