একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এটি যদিও একটি দু:খজনক সংবাদ কিন্তু হাজারো দু:খের মাঝে বিষয়টি যেন হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে এই জন্য বলছি যে, এটি তেমন একটি মিডিয়া কাভারেজ পায়নি। ধরেই নেয়া হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা তো অহরহই ঘটে থাকে তাহলে এটি আর অতিরিক্ত কি হয়েছে। এটিও ভীষণভাবে দু:খজনক।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো আসলে মারামারি, কাটাকাটি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি আর রাজনীতির নামে সব ধরনের মাস্তানী করা নয়। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ভাষা আন্দোলনে, পাকশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, স্বৈরশাসক ও সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা গৌরবজ্জোজল ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরাসরি রাজনীতি করার এবং রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করার তখন প্রয়োজন ছিল, তারা তাই করেছে। কিন্তু এখন? এখনতো শিক্ষার্থীদের রাজনীতির ধারা পাল্টাতে হবে, গুণগত মানের রাজনীতি করতে হবে। কিন্তু হচেছ তো পুরো উল্টো টা। প্রতিটি বিষয়েই যেন উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নাম কুড়াচেছ যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র সম্পুর্ন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা এরশাদ আমলের পুরো সময়টাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি।তখনও র্যাগ ডে পালন করা হতো। যদিও র্যাগ ডে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন এক নয়, তারপরেও শেষদিনকেই তারা ’র্যাগ ডে’ হিসেবে পালন করার ট্রাডিশন চলে এসেছে। শেষদিন অবশ্য ’সমাপনী দিবস’। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তেরতম ব্যাচ ঠিকই ’সমাপনী দিবস’ পালন করেছি, র্যাগ ডে পালন করিনি। অনেকটাই শালীনতা বজায় রেখে সমাপনী দিবস পালন করেছি যদিও দুচারজন রাতের অনুষ্ঠনে স্টেজে উঠে মদ্যপান করেছিল কিন্তু অযাচিত কোন ঘটনা ঘটেনি। র্যাগ ডে পালন আসলে গ্রীক কালচার। সপ্তম-অষ্টম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট নিয়ে আসার জন্য র্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। শব্দটি কিন্তু ইংরেজি।
ইউরোপে এর প্রচলন ঘটে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি। ১৮২৮-১৮৪৫সালে দিকে র্যাগিং সপ্তাহের প্রচলন ঘটে আমেরিকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তবে ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এই প্রচলন আর নেই। সেই জায়গা দখল করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আমরা ভারতীয় লেখকদের অনেকের লেখায় পাই র্যগডে-র অসহনীয় জøালাতনের বর্ণনা। শ্রীলংকাতেও আছে। তবে এটি আবার ভিন্নমাত্রার। সেটি হচেছ নতুন শির্ক্ষাথীরা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে, তাদেরকে বরণ করে নেয়া
এরশাদ আমলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ’র্যাগ ডে’ পালন করা হতো। এটিও ঠিক নবীনবরণ নয়, বিদায়ী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনুগলোতে পালন করতো ’ র্যাগ ডে’। তার দু’একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক র্যাগ ডেতে একজন শিক্ষার্থীর এক চোখে চশমা, অন্যচোখের চশমার গ্লাসটি ভাঙ্গা, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি, এক পায়ে প্যান্ট পড়া, অন্যপায়ের প্যান্ট অর্ধেকছেড়া, তাকে সহপাঠীরা একটি ঠেলাগাড়ীতে নিয়ে যাচেছ এবং শ্লোগান দিচেছ’ স্যাক খেয়েছে আমার ভাই, সুন্দরীদের রক্ষা নাই। ’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পুর্ববর্তী দু’ একটি ব্যাচের র্যাগ ডেতে যা যা করা হয়েছিল। তিনদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও ক্যাম্পাসের সমস্ত জায়গায় বিভিন্ন ধরনের অর্থ ও ছবিসম্বলিত পোষ্টার লাগিয়ে ক্যাম্পাস ছেয়ে দেয়া হয়েছিল। একটি পোষ্টারে দেখা যাচিছলো –একটি ঠেলাগাড়ীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স তুলে শিক্ষার্থীরা ঠেলে নিয়ে যাচেছ। আর একটি ছবিতে কিছু শিক্ষার্থী দেখা যাচেছ দ্রুত ডাইনিং হলে ঢুকছে এবং বাথরুমে বদনায় ডাল ভরছে আর বলছে –বাথরুমে পানি নেই, তাই ডাল দিয়াই—’। এগুলো অতটা শালীন না হলেও কিছু মেসেজ ছিল। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাম্বুলেন্স রোগী নিবে কি, এ্যাম্বুলেন্সেকেই শিক্ষার্থীরা ঠেলাগাড়িতে ঠেলে নিয়ে যাচেছ। ডাইনিং হলে ডাল আর পানির মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই আর হলে অনেক সময় পানি থাকেনা। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ের চেয়ে জাহাঙ্গীরনগরে খাবারের মান, হলে থাকার অবস্থা অনেকটাই ভাল ছিল। তারপরেও এই অবস্থা যা বিদায়ী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পোষ্টারের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল।
আরও কিছু পোষ্টার ছিল। একটি মেয়ের চার ধরনের ছবি ছিল বড় একটি পোষ্টারে। প্রথম ছবিটিতে প্রথম বর্ষের টিপটপ এবং স্মার্ট একটি মেয়েকে এক ছেলে প্রস্তাব দিচেছ আর মেয়েটি তা প্রত্যখ্যাানের সুরে বলছে ’ আমার ইয়ে না আমেরিকায় থাকে।’ মেয়েটি দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে এবং আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে তার কোমনীয়তা তখন অন্য আর একটি ছেলেকে বলছে, ’আমার ও বুয়েটে পড়ে।’ তৃর্তীয় ছবিতে মেয়েটি আর একটু বয়স্ক হয়েছে এবং স্মার্টনেস কিছুটা কমেছে এবং আর একটি ছেলেকে বলছে’ আমার প্রেমিক ঢাকা মেডিকেলে পড়ে।’
মেয়েটি যখন মাষ্টার্সে পড়ে তখন তার চেহারার সেই কমনীয়তা নেই, শরীর অনেকটাই মুটিয়ে গেছে এবং কিছুট চিন্তাশীল মনে হচেছ তখন সে প্রথম বর্ষ থেকে যে ছেলেটি তার পেছনে পেছনে ঘুরতো এবং যে আশা ছেড়ে দিয়েছিল তাকেই মেয়েটি বলছে’ তুমিই সই, তুমিই আমার আসল প্রেমিক।’এগুলো একেবারে শালীন না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কিছু চিত্র ও মেসেজ বহন করতো।আর একটি ছবিতে দেখা যাচেছ প্রেমিক-প্রেমিকা রাস্তায় বসে আছে একে অপরের নিবিড় সান্নিধ্যে। পথচারী শিক্ষার্থীরা পথে দাঁড়িয়ে পড়ছে কারণ সামনে একজন বড় শিক্ষার্থী বলছে, ’ রাস্তা বন্ধ কাজ চলছে। ” এটি যদিও শালীনতার পর্যায়ে পড়েনা তারপরেও এরকশ চিত্র অহরহ দেখা যেত, এখনও যায় যা বিদায়ী শিক্ষার্থীরা তুলে ধরতে ভোলেননি।
যদিও বলা হয় যে, বিনোদনের অংশ হিসেব র্যাগ ডে উদযাপন করা হয়, শেষ পর্যন্ত তা নতুনদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মূলত র্যাগ ডে হচেছ নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে আনন্দের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে তাদের সংকোচ কাটিয়ে ওঠার দিন। অথচ দেখা যায় এটি হয়ে ওঠে একটি আত্মতৃপ্তি ও প্রতিশোধ নেওয়ার দিন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিদায়ী কিংবা উঁচু শ্রেণির এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীরা নি¤িœলিখিত কারণে নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে অত্যাচারমুলক, প্রতিশোধমুলক আচরণ করে থাকে –(ক) অবচেতন মনে নতুন শিক্ষার্থীদের প্রতিদ্বন্দী মনে করা (খ) নিজের জীবনের কিছু অতৃপ্ত কামনা-বাসনা, মানসিক ও শারীরিক অতৃপ্তির বহি:প্রকাশ ঘটায় নতুনদের প্রতি ভিন্নধর্মী আচরণের মাধ্যমে (গ) নুতন ছাত্রছাত্রীদের ওপর নিজেদের ক্ষমতার বহি:প্রকাশ ঘটানোর ইচছা পোষণ (ঘ) সিনিয়র দ্বারা নিজেদের পূর্ব র্যাগিংয়ের প্রতিশোধ নেওয়া। (ঙ) জোরপূর্বক ভবিষ্যত অনৈতিক কাজে সাহায্যকারী হিসেবে তাদের ব্যবহারসহ নানা করনে র্যাগ ডে পালন করা হয়।
ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের গাইড হিসেবে কাজ করে অষ্টম শ্রেণির ক্যাডেটর। নতুন শিক্ষার্থীকে বুঝিয়ে দেয় ক্যডেট কলেজের নিয়ম কানুন। কিভাবে ডাইনিং হলে খেতে হবে, কিভাবে ঘুমাতে হবে, কিভাবে টাই পড়তে হবে, কিভাবে র্যাংক পরা সিনিয়র ক্যাডেটদের, প্রিফেক্টদের সম্মান করতে হবে ইত্যাদি। এগুলো ভাল দিক। কিন্তু কয়েকদিন পরে দেখা যায় ঐ গাইডই নতুন শিক্ষার্থীকে পানিসমেন্ট দেওয়া শুরু করে। তার ব্যক্তিগত কাজ করায়। দুপুরে রেষ্ট টাইমে যখন ঘুমানেরা কথা তখন সিনিয়র ক্যাডেটটি না ঘুমিয়ে নতুনকে দাঁড় করিয়ে রাখে কোন হাউস টিউটর আসে কিনা তা দেখার জন্য। আর দ্বাদশ শ্রেণির ক্যাডেটরা র্যাংক পারার সাথে সাথে জুনিয়রদের পানিসমেন্ট দেওয়া শুরু করে। কারণে, অকারণে, এখানে সেখানে পানিসমেন্ট চলতেই থাকে।
আমি প্রায়ই ওদের জিজ্ঞেস করতাম পানিসমেন্ট না দিলে কি হয়। ওরা উত্তর দিত’ স্যার আমরা যে পানিসমেন্ট খেয়েছি , তাতো তুলতে হবে।’ কেউ কেউ বলতো পানিসমেন্ট না দিলে তো স্যার ট্রাডিশনটা থাকবে না। কেউ কেউ বলতো ’ স্যার পানিসমেন্ট দিয়ে এক ধরনের মজা পাই।’ একদিন দেখলাম একজন ক্যাডেট কোরাণের হাফেজ যাকে শিক্ষকরাও পানিসমেন্ট দিতেন না, দেওয়ার প্রয়োজনই হতো না অথচ হাউস সে ’ নেল-ডাউন’ হয়ে আছে।আমি হাউস ডিউটিতে গিয়ে ওর ঐ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম ’ ব্যাপারটি কি’ সে উত্তরে বললো স্যার অমুক ভাইয়া কমান্ড করেছে।
আমি সেই হাউস লিডারকে ডেকে বললাম ’ এই ক্যাডেটটি কোরাণের হাফেজ, তাকে আমরা আলাদা সম্মান করি, তোমাদেরও তো করা উচিত। পরে ছেলেটিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের কিছু খারাপ ট্রাডিশন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছে। আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে দেখেছি জুনিয়র ক্যাডেটারা ডাইনিং হলে লবন ছাড়া খাবার খেয়ে ওঠে যখন লবণের বাটি সিনিয়রদের দিকে থাকে কারণ তারা তা চাইতে পারেনা। তবে, ক্যাডেট কলেজে নবীনদের আসার দিন এবং বিশেষ করে ’নভিসেস প্যারেডে’র মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যেদিন নতুন ক্যাডেটদের ক্যাডেট কলেজের ইউনিফর্ম পরিয়ে সবার সাথে জুড়ে দেওয়া সেটি একটি চমৎকার দৃশ্য এবং অনেক শিক্ষাণীয় বিষয় থাকে সেখানে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও পরিবেশ থেকে আসা নতুন শিক্ষার্থীরা সাংঘাতিক এক যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের যেভাবে বরণ করা হয়। অনেকেই মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। কারু কারু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিতে দেখা যায়। এমন ঘটনাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে- এক শিক্ষার্থী আরেক শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে আর বাকিরা দাঁড়িয়ে থাকে এবং মজা দেখে। এই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা? অতি সম্প্রতি আমরা দেখলাম যে একসহপাঠীকে বেদম প্রহার করে যখম করে দিয়েছে, চোখে মারাত্মক আঘাত দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু প্রশসন নয়, ব্যক্তি শিক্ষার্থীকেও মনে রাখতে হবে যে, আমি একটি উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছি আমার আচরণ হবে অন্যের জন্য অনুকরণীয়। আমি যে পার্টিই করিনা না কেন, আমি যত শক্তিশালীই হইনা কেন’ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আমার অচরণ হতে হবে সর্বোত্তম। আব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিশাল দায়িত্ব তো রয়েছেই।
তাদের প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে, এটা আমরা সবাই জানি তারপরেও অনেক কিছু তারা করতে পারেন। সততার পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে থাকলে অনেক বাধা বিপত্তি দূর করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সীট সাধারনত ছাত্র নেতারা বিতরণ করে থাকে, হল প্রশাসন এখানে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে আমাদের প্রভোষ্ট প্রয়াত ড. কবির আহমদ নিজে লটারীর মাধ্যমে আমাদের সীট বন্টন করে দিতেন, ফলে ছাত্র নেতাদের সেখানে তেমন কিছু করার ছিলনা। জানিনা এখন জাহাঙ্গীরনগরে কিভাবে সীট বন্টন করা হয়।
র্যাগ ডে মানে আনন্দের দিন।হৈ হুল্লোড় করে আনন্দ প্রকাশ করা।বিশ্বদ্যিালয় শিক্ষাজীবন সমাপ্তিতে কিংবা নতুনদের বরণের দিন—র্যাগ ডে হিসেবে যেদিনই পালন করা হোক না কেন তা হতে হবে শিক্ষামূলক। সেখানে থাকবে সভ্যতার ছাপ। কিন্তু র্যাগ মানে রসিকতার নামে কাউকে জøালাতন করা, অত্যাচার করা যা অনেকটাই অপসংস্কৃতির ছায়া। এগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাস দিতে হবে। ।আমাদের ব্যাচের ’সমাপনী দিবসে’ আমাদের এক লম্বা ক্লাসম্টে ( ইতিহাস বিভাগের) ছোট একটি হাফপ্যান্ট এবং ছোট একটি পাঞ্জাবী পড়ে, তার রুমের সমস্ত খাতাবালিশ ও লোটা নিয়ে সবার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচেছ আর বলছে, শেষ ঠিকানা লেডিস হলে যাচিছ।’ আনন্দের বহি:প্রকাশ তবে, একেবারে শালীনও ছিলনা বিষয়টি ।উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যাই করবে , যে ধরনের মজাই করুক না কেন তাতে নান্দনিকতার ছাপ থাকতে হবে, সমাজ বাস্তবতা এবং অনাচারের বিরুদ্ধে একটি মেসেজ থাকতে হবে। অনর্থক আনন্দ উল্লাসে থাকে সাময়িক সুখানুভূতি, কিন্তু এর ভবিষ্যত পরিণতি খুব একটা ভাল হয় না। যদি অশ্লীলতমুক্ত র্যাগ ডে পালন করা যায়, তার মধ্য দিয়ে সামাজিক অনাচার ও বিশ্বদ্যিালয়ের দুর্বল দিকগুলো হাসি আনন্দের মধ্যে দিয়ে তুলে আনা যায় তাহলে তার মূল্য আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়ে ৪৭তম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় গত ০৫ ফেব্রুয়ারী ( ২০১৮)। ০৭ ফেব্রুয়ারী ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নতুনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।সাধারণভাবে আশা করা যায় বা করা হয় যে, সিনিয়র শিক্ষার্থীরা নতুনদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে , হল, বিভাগ, পরিবেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাল-মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত করবে। সুন্দর সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, একে অপরের সাথে চমৎকার এক পরিবেশের মাধ্যমে পরিচিত হবে, সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে। কিন্তু এ হচেছটা কি? অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও কষ্টের পর একজন মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
এটি তার সাংবিধানিক ও জন্মগত অধিকার। অথচ এতকিছুর মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার থাকার জায়গা হয়না। তার বৈধ জায়গায় দেখা যায় বাইরের ছেলেমেয়েরা, ক্যাডার, ইত্যাদি ধরনের লোকজন হল দখল করে রাখে। নতুনদের সিট নিতে হলে ক্ষমতাবান কোন পার্টি করতে হবে, পার্টির নেতাদের সব ধরনের আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হয়, যখন তখন তাদের মাস্তানির শিকার হতে হয়। কোথায় পড়াশুনা, কোথায় গবেষণা, কোথায় দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া গুণাবলী অর্জন করা? সবই যেন জলে ভেসে যাচেছ। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, দেশের নেতৃত্বকে সৎভাবে চিন্তা করতে হবে। দেশকে যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিবে তাদেরকে আমরা এই পরিবেশে শিক্ষাগ্রহন করতে দিতে পারিনা। তাহলে তারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে সে বিষয়টিকে আমাদের সর্বত্তম গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আদর্শ ও সবোত্তম শিক্ষালয় হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আসুন সবাই মিলেমিশে কাজ করি।
লেখক: মাছুম বিল্লাহ, লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।