এই মুহূর্তে দেশের সব কটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত টক শোতে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে—এটিই পরিষ্কার হবে। আবার পত্রপত্রিকার শীর্ষ খবরেও প্রায়ই ডাকসুসহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা হতাশা, অভিযোগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে যে বিষয়টি সাংবাদিক, আলোচক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্রনেতারা দেওয়ার চেষ্টা করছেন সেটি হচ্ছে, দেশে তিন দশক ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠিত হতে পারছে না! বিষয়টি আমার কাছে সব সময়ই প্রশ্নবোধক ছিল। কেননা দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বলতে ছাত্রসংসদে নির্বাচিত নেতারা কতটা হতে পারেন, তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া কোনো দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হচ্ছে মেধাবী, দক্ষ, যোগ্য, সৃজনশীল, উদ্ভাবনশীল এবং নানা গুণে গুণান্বিত নানা পেশার জন্য আধুনিক বিশ্বের উপযোগী মানসম্মত মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলা। ছাত্রসংসদের অবদান এই প্রক্রিয়ায় একেবারেই সামান্য। অথচ আমরা ছাত্রসংসদকেই একমাত্র বিষয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছি। এমনকি রাজনীতিতেও যাঁরা আসবেন, তাঁদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের সিঁড়ি বেয়ে আসার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দেখতে চাই—এমন ভাবনা সবার মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এটি কতটা সম্ভব, সেটি আমরা খুব একটা তলিয়ে দেখছি না।
আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষা এখন একদিকে সংখ্যার বিবেচনায় ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে, অন্যদিকে গুণের মানদণ্ডে বিচার করলে খুবই হতাশায় পড়তে হয়। দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসায় লেখাপড়া করছে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগেরই মানের অবস্থান শূন্যের কোঠায় বিরাজ করছে। সেগুলোতে না আছে পড়াশোনা করার কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষক, অবকাঠামোগত বাস্তবতা, উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা এবং দক্ষ, যোগ্য ও সৃজনশীল উচ্চতর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করার কোনো ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী যেসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে, সনদ লাভের দাবি করে, তাদের বেশির ভাগই ওই বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না। কলেজগুলোতে ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত এতটাই প্রকট থাকে যে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষার পরিবেশ তাদের অনুকূলে রাখা ছাড়া কর্তৃপক্ষের অন্য কোনো সুযোগ নেই।
ছাত্রসংসদ ওই সব কলেজে বিদ্যমান থাকলে এর বাইরে কি তাদের যাওয়া মোটেও সম্ভব? বরং ছাত্রসংসদ এসব কাজে আরো বেশি জড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংস্থার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা ছাড়া অন্য কোনো অবদান রাখার পর্যায়ে আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে কলেজগুলোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষাকে নিয়ে গেছে, তাতে দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনশীল উচ্চশিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলা এখন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দরকার ছিল অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, যোগ্য শিক্ষক, গবেষক ও আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেভাবেই শিক্ষার্থীদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করে সনদ পাওয়ার অধিকার লাভ করা। একইভাবে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান ও গবেষণাকে যেভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব, সেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতে বাধ্য করা। একইভাবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষার কারিকুলাম বিন্যস্ত করা, গবেষণায় শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা, তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার গভীরতা ও ব্যাপকতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা, সেভাবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ, অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং উচ্চশিক্ষার মান বজায় রেখে প্রতিটি বিষয়ে দক্ষ ও মেধাবী উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করা।
একই সঙ্গে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা অর্জন করার পরিবেশ নিশ্চিত করা। ছাত্রাবাসগুলোতে আমাদের দেশে বরাবরই শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করা, সুস্থ, স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বসবাস করার পরিবেশ বিঘ্নিত ছিল। ছাত্রসংগঠনগুলো ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রাবাস ও হলগুলোতে যেভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, সেটি কোনো আধুনিক সভ্য দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত দেখা যায় না, ভাবাও যায় না। কোনো প্রশাসনকেই তোয়াক্কা না করার স্বেচ্ছাচারিতা তাদের মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা যায়। বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী লেখাপড়ার সঙ্গে খুব একটা যুক্ত নয়। শ্রেণিকক্ষে তাদের খুব একটা দেখাও যায় না। তারা হোস্টেলে কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিল বা আড্ডা দিয়ে যেভাবে সময় কাটায়, এরপর তারা কিভাবে বিষয়জ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষিত নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে, সেটি মস্ত বড় প্রশ্নের বিষয়।
আজকের দুনিয়ায় কোনো দেশকে সামগ্রিকভাবে উন্নতি করতে হলে তার প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের—যাঁরা ওই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান রাখেন, পড়াশোনা করেন, গবেষণা করেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরই উচ্চতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ প্রায় নেই। এটি বাদ দিয়েই তারা উচ্চশিক্ষার সনদ লাভ করে। তারাই বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আবার অনেকেই একটি তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির চাকরি পেতে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেয়, যারা চাকরি বাণিজ্য করে, তাদের হাতে মা-বাবার সঞ্চয় তুলে দেয়। কিন্তু তার পরও চাকরির বাজারে তাদের মূল্য খুব কমই হয়। অথচ এই শিক্ষার্থীদের সবাইকে যদি উন্নত বিশ্বের মতো উচ্চশিক্ষার পরিবেশ দেওয়া হতো, তেমন অধ্যাপকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো কিংবা গবেষণায় অভ্যস্ত হতে হতো, লাইব্রেরিতে মৌলিক বই-পুস্তক পড়ার বাধ্যবাধকতা অতিক্রম করতে হতো, হোস্টেলে সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা অতিবাহিত করার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আমার বিবেচনায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর জ্ঞানী, দক্ষ ও বিশেষজ্ঞে পরিণত হতে কোনো বাধা থাকত না। তাদের দেশ ও জাতির উন্নয়নে সব ক্ষেত্রে অংশ নিতে কোনো ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না।
কিন্তু আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এতটাই মানের সংকটে রয়েছে যে সেখানে আমরা জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বিশেষজ্ঞ খুব বেশি পাচ্ছি না। আমাদের গার্মেন্টসহ উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে যার যার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে মানের সংকট কত গভীরে, তা শুধু নিজ নিজ ক্ষেত্রে তলিয়ে দেখা গেলে দৃষ্টিতে আসে; যে মান নিয়ে আমাদের আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকার কোনো ভরসাই করা যায় না। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী, দক্ষ, যোগ্য, নিবেদিতপ্রাণ, দেশপ্রেমিক ও সৃজনশীল গবেষক, লেখক, শিক্ষকের সংখ্যা হাতে গোনা। অন্যত্রও বিষয়টি একই রকম। এর কারণ হচ্ছে, আমরা যুগ যুগ ধরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে ধরনের গর্ব করে আসছি, তা থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ আমরা তৈরি করতে পারছি না। আমাদের রাজনীতিতে আমরা প্রতিদিন যাঁদের দেখছি তাঁদের কয়জনই দেশের আর্থ-সামাজিক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বাস্তুতাত্ত্বিক ধারণা যথাযথভাবে রাখেন? আমরা সংসদসহ জাতীয় নির্বাচনে এখনো যাঁদের অংশগ্রহণ করতে দেখি তাঁদের অনেকেই দেশকে বিশেষ বিশেষ খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখেন বলে মনে হয় না। অথচ রাজনীতিতে এখন তরুণরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
লাখ লাখ তরুণ লেখাপড়ায় নিজেদের যোগ্য করার চেয়ে ছাত্রসংগঠন বা রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কিছু হওয়া বা পাওয়াকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। অথচ তারা যদি লেখাপড়া ঠিক রেখে এই কাজ করত, তাহলে দুই কূলই রক্ষা পেত। দেশ রাজনীতি-সচেতন অনেক উচ্চশিক্ষিত বিশেষজ্ঞকে রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় পেত, যারা দেশকে আজকের দুনিয়ায় দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারত। কিন্তু আমরা সেই দক্ষতা বোধ হয় তেমনটা পাচ্ছি না। একুশ শতকের এই সময়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছাড়া দেশকে উন্নতি, অগ্রগতি, শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুশাসনে ভরা দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারা মোটেও সহজ কাজ নয়। আমরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্রসংসদ নির্বাচনের কথা ভাবি, সেখানে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারা কি আদৌ উচ্চশিক্ষার জ্ঞান ও দক্ষতায় কৃতী ছাত্র-ছাত্রী? তেমন কৃতীরা কি এসব নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী? কিংবা তাদের নির্বাচিত করার কথা কেউ কি ভাবছে? অথবা নির্বাচিত হলেও কি ছাত্রসংসদগুলো শিক্ষা-সংস্কৃতি, গবেষণা ও দেশপ্রেমের চর্চায় আদৌ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করতে পারবে? পশ্চিমে আমরা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের কথা কিছুটা শুনি; কিন্তু সেটির রূপ কী, তা আমরা জানি না।
তবে সেটি যে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষার নানা ঘাটতির মধ্যে দখল-বেদখলের সংস্কৃতিতে আবদ্ধ নয়, সেটি সেখানে খোঁজ নিলেই জানা যাবে। সেসব নির্বাচনে নেই কোনো বাড়াবাড়ি, গণমাধ্যমে অহেতুক উত্তেজনা, রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই কোনো সিঁড়ি রচনার পাঁয়তারা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে সনদ লাভ করছে তারাই দেশ ও জাতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। মেধা ও যোগ্যতার সিঁড়ি বেয়ে তারাই দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমনকি রাজনীতি এবং সরকারেও। আমরা বিশ্বের বাস্তবতার এসব খোঁজখবর কমই রাখছি। আমাদের তরুণদের মেধার বিকাশ কোন পথে, সেটিকে তাদের সামনে তুলে না ধরে যে হাতপাখায় বাতাস দিচ্ছি, সেটি আসলেই রূপকথার, বাস্তবের নয়।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ