বছরের শুরুর দিনগুলোতে কী যে ভালো লাগে যখন দেখি ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন বই নিয়ে হৈচৈ করে বাড়ি ফিরছে! সমকালেই পড়লাম, নতুন বছর শুরু হতে না হতেই নতুন পাঠ্যবই বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী তা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। করোনাকালের নানা প্রতিকূলতা ও বৈরী পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশের কোটি কোটি শিশুর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া সরকারের এক বিরাট অর্জন। সোমবার (১৮ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমাদের তিন ছেলেমেয়ে গত শতকের শেষ দশকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। বছরের শুরুতে তখন তাদের জন্য বই সংগ্রহ করা কী যে অনিশ্চিত ও কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল! ঠিক সময়ে বই বাজারে পাওয়া যেত না, বই পাওয়া গেলেও তা কেউ পেত, কেউ পেত না। বইয়ের মূল্যেও ছিল তারতম্য। শিক্ষা বছরের শুরুতেই বই বঞ্চনার যন্ত্রণায় কষ্ট পেত বেশিরভাগ শিশু, বিশেষ করে শহর থেকে দূরের প্রান্তিক ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা।
সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, আমাদের শিক্ষাবান্ধব সরকার চিন্তাভাবনা করছে বছরের শুরুতে বই বিতরণের পাশাপাশি স্কুলের ইউনিফর্ম কেনার জন্য শিশুপ্রতি এককালীন কিছু টাকা ভবিষ্যতে দেবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে কারিতাস কর্তৃক পরিচালিত একটি শিশু শিক্ষা প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা নূ্যনতম মানের পোশাকের অভাবে স্কুলে আসে না, স্কুলে আসা শুরু করলেও পরে অনিয়মিত হয়, এমনকি তাদের কেউ কেউ ময়লা ও ছেঁড়া পোশাকের কারণে হীনমন্যতায় ভোগে। স্কুলে না আসার ও অনিয়মিত হওয়ার পেছনে আরও কয়েকটি দিকের সঙ্গে উপযুক্ত পোশাকের অভাবের বিষয়টি ছিল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন স্কুলে ইউনিফর্ম শুরু করার বিষয়টি খুব মনে পড়ে। বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমার পক্ষে ইউনিফর্ম বানানো সম্ভব হয়নি। ইউনিফর্ম ছাড়া স্কুলে যাওয়ায় আমাদের প্রথম দুই পিরিয়ড মাঠে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। বাকি পিরিয়ডগুলোতে ক্লাসে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে ছিলাম। আবারও শাস্তি পাব সেই ভয়ে পরের দু'দিন আর স্কুলে যাইনি। আমি তখন মামাবাড়িতে থাকতাম। আমার স্কুলের ইউনিফর্ম বানানোর কোনো উদ্যোগ সেখানে কেউ নিচ্ছেন না দেখে বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। আমার কান্নাকাটিতে কোনো উপায় না পেয়ে মা তার দুটো রুপার বাতানা (চুড়ি) দেন, যা বিক্রি করে একটি সবুজ হাফশার্ট ও একটি নীল হাফপ্যান্ট বানিয়েছিলাম। বানানো ইউনিফর্ম পেয়ে তৃতীয় দিন থেকে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলেও আমার সঙ্গে শাস্তি পাওয়া কয়েকজন আর কোনো দিন স্কুলে আসেনি। আমার কেন জানি এখন মনে হয়, তাদের মায়েদের কারও কোনো বাতানা ছিল না। আমি তখন ছিলাম তাদের চেয়েও সৌভাগ্যবান।
শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষা উন্নয়নকে করে স্থায়িত্বশীল বা টেকসই। উপরন্তু শিক্ষা মানুষকে করে দক্ষ কর্মী, মর্যাদাশীল ব্যক্তি, দায়িত্ববান নাগরিক ও মানবিক মানুষ। তাই বিশ্বের অনেক দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা নিখরচায় করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষায় বিনিয়োগ যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ তা উপলব্ধি করেই সেসব দেশের সরকার এই এত বড় দায়িত্ব পালন করছে। পেছনে ফেলে আসা শত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শিক্ষিত জাতি উন্নয়ন ধরে রাখতে পারে। কম শিক্ষিত জাতি উন্নয়ন ধরে রাখতে পারে না। আমাদের উন্নয়নের গতির চাকা সচল রেখে অভীষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্যে পরিকল্পনা মাফিক পৌঁছাতে ও পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে শিক্ষাব্যয় ও শিক্ষার সুযোগ অবশ্যই বাড়াতে হবে। সরকারের বিনামূল্যে বই বিতরণ দেশে শিক্ষা বিস্তারে খুব বড় একটা সফল উদ্যোগ হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুরূপ আরও এক যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে স্কুল পোশাকের জন্য শিশুপ্রতি এককালীন সমপরিমাণের অর্থ প্রদান। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট সব পর্যায়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচিত হবে, এই আশা রাখি।
লেখক : ড. আলো ডি'রোজারিও, প্রেসিডেন্ট, কারিতাস এশিয়া; সাবেক নির্বাহী পরিচালক কারিতাস বাংলাদেশ