এই দেশের মেয়েদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে: জাফর ইকবাল - দৈনিকশিক্ষা

এই দেশের মেয়েদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে: জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

আমাকে যদি কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কী, তাহলে আমি একেবারে চোখ বুজে উত্তর দেব যে সেটি হচ্ছে, এই দেশের সবকিছুতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এগিয়ে আসছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি পাঁচ কোটির মতো এবং এর অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে। শুধু যে সংখ্যায় অর্ধেক মেয়ে তা নয়, আজকাল লেখাপড়াতেও মেয়েরা ছেলেদের থেকে ভালো করতে শুরু করেছে। যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয় তাহলে কিন্তু দেখা যাবে, সুযোগ-সুবিধা হয়তো ছেলেরাই বেশি পাচ্ছে। 

একসময় আমরা পাকিস্তান নামক একটি দেশের অংশ ছিলাম। ভাগ্যিস, সেই দেশটি থেকে সময়মতো আলাদা হয়েছি। সেই দেশে একটি মেয়ে লেখাপড়া করতে চেয়েছিল বলে তার মাথায় গুলি করে দেওয়া হয়েছিল। নোবেল পুরস্কার দিয়ে কোনোমতে সম্মানটি রক্ষা করতে হয়েছে। প্রায় নিয়মিতভাবে সেই দেশে এখনও মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো, ছেলে হোক মেয়ে হোক সবাই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, সময়মতো ঝকঝকে নতুন বই পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মেয়ে হলে লেখাপড়া করার জন্য মাসে মাসে টাকা পাচ্ছে। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে অনেকে মনে করত, মেয়েদের শিক্ষক বা ডাক্তার হওয়াটাই বুঝি সহজ। তাই এই দেশে শিক্ষক ও ডাক্তারের মাঝে মেয়েদের সংখ্যা বেশি; কিন্তু যখন এই গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হতে শুরু করেছে, তখন অন্য সব জায়গাতেও আমরা মেয়েদের দেখতে শুরু করেছি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে দেখেছি, নারী পাইলট, কো-পাইল আর ক্রুরা মিলে বিশাল বিমান ঢাকা থেকে উড়িয়ে লন্ডন নিয়ে গেছে। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক প্রথম পুরস্কারটি এনেছে নারী ক্রিকেট দল। পথেঘাটে নারী পুলিশ দেখে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, আজকাল সেটি আলাদা করে চোখেও পড়ে না। সেনাবাহিনীতে নারীরা আছেন। রাজনীতিতে আছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী কাজ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশটিকে গ্লানিমুক্ত করা। সেই কাজটির জন্য এককভাবে কৃতিত্বটি দিতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যিনি একজন নারী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের কাজ করতে দেখে আমরা কিন্তু পুরুষ-নারীর বিভাজনটি ভুলে যেতে শুরু করেছি। সবাইকেই মানুষ হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি; কিন্তু পশ্চিমা জগতের মিডিয়া বিবিসি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের মতো সাপ্তাহিকী কিন্তু এখনও যথেষ্ট শিক্ষিত বা উদার হতে পারেনি। তারা আমাদের বর্তমান কিংবা আগের প্রধানমন্ত্রীদের এখনও অবমাননাকর 'বেগম' শব্দটি দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, যারা বেগম শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদেরকে এই শব্দটি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়। 

আন্তর্জাতিক নানা ধরনের জরিপেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো দেখে কেউ যেন মনে না করে, আমাদের দেশে নারীদের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, তার সবকিছু করা হয়ে গেছে। এটি মোটেও সত্যি নয়। খবরের কাগজে মাঝেমধ্যেই আমরা মেয়েদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খবর দেখি। যখনই এ রকম একটি খবর দেখি, তখনই মনে মনে হিসাব করে নিজেকে বলতে হবে, এই খবরটি খবরের কাগজ পর্যন্ত এসেছে। এ রকম আরও অনেক খবর আছে, যেগুলো খবরের কাগজ পর্যন্ত আসেনি। আমরা শুধু ধর্ষণ-গণধর্ষণ জাতীয় ভয়ঙ্কর খবরগুলোকে নির্যাতন হিসেবে দেখি; কিন্তু একজন নারী যখন একজন পুরুষ মানুষের সমান সমান কাজ করে কম বেতন পান, সেটিও যে এক ধরনের নির্যাতন, সেটি আমাদের মাথায় আসে না। যেসব মেয়ে পথেঘাটে চলাচল করে, বাসে ওঠার চেষ্টা করে, তাদের সবারই প্রায় নিয়মিতভাবে পুরুষের অশালীন হাতের স্পর্শ সহ্য করতে হয়। একজন পুরুষ মানুষ যখন তার নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলে, ঠিক সেই সময় একজন নারীকে সন্তান জন্ম দিতে হয়, তাকে বুকে আগলে বড় করতে হয়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নারীদের সংখ্যা কম। নারীরা যেন পুরুষের পাশাপাশি সব জায়গায় আসতে পারে, তার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে; কিন্তু নারীদের সব জায়গায় সমান সমান অধিকার পাওয়ার জন্য আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের দেশের মেয়েরা কিংবা নারীরা কেন অন্য দেশের মেয়ে কিংবা নারী থেকে অনেক বেশি তেজস্বী, সে ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা থিওরি আছে। ১৯৭১ সালে এই দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে। তুলনামূলকভাবে সেখানে পুরুষ মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল। একটা সংসারে যখন পুরুষ মানুষটি মারা যায়, তখন পুরো পরিবারটি পথে বসে যায়। কাজেই ১৯৭১ সালে এই দেশের অসংখ্য নারী আবিস্কার করেছে, তাদের সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। একজন মা তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শরীরের শেষ বিন্দু রক্ত পর্যন্ত দিতে রাজি থাকে। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘরের ভেতর আটকে থাকা অসংখ্য স্বামীহারা মা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন। সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা পুরুষের পাশাপাশি নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন। আমি এটা জানি; কারণ আমার মা ঠিক এ রকম একজন নারী ছিলেন। আমি আরও নারীদের কথা জানি, যারা এভাবে তাদের সন্তানদের রক্ষা করেছেন। আমার ধারণা, এই কারণে আমাদের দেশের নারীরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি তেজস্বী। আমার এই থিওরিটি কতখানি সত্য, আমি কখনও পরীক্ষা করে দেখিনি; কিন্তু আমার ধারণা, এর মাঝে সত্যতা আছে। 

আমাদের দেশের জিডিপি ১৭৫১ ডলার থেকেও বেশি এবং সেটি আরও বাড়ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রুও এখন এই দেশের অর্থনীতিকে সমীহ করে- পাকিস্তান পর্যন্ত বাংলাদেশের মডেলের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে! এই শক্ত অর্থনীতির একটা বড় অংশ এসেছে গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে এবং এই গার্মেন্টের শ্রমিক বেশিরভাগই নারী। কাজেই এই দেশে আমরা যদি নারীদের অবদানটুকু যথেষ্ট কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ না করি, কেমন করে হবে? 

তাই এই দেশে যখন কেউ মেয়েদের নিয়ে কোনো এক ধরনের অসম্মানসূচক বা বৈষম্যমূলক কথা বলে, দেশের মানুষ যথেষ্ট বিচলিত হয়। সর্বশেষ বক্তব্যটি ছিল মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে। হেফাজতে ইসলামের আমির বলেছেন, মেয়েদের প্রাইমারি স্কুলের বেশি লেখাপড়ার  কোনো প্রয়োজন নেই। তার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, তাহলে মেয়েদের নিয়ে পুরুষরা টানাটানি করবে। 

বক্তব্যটি অবিশ্বাস্য; এর আগের বক্তব্যটির মতোই- যখন দাবি করা হয়েছিল, মেয়েরা তেঁতুলের মতো এবং তাদের দেখলেই পুরুষ মানুষের জিবে লোল চলে আসে। বক্তব্যগুলো মেয়েদের জন্য যেটুকু অবমাননাকর, পুরুষদের জন্য তার থেকে অনেক বেশি অবমাননাকর। কেউ যদি এই কথাগুলো বিশ্বাস করে, তাহলে ধরে নিতেই হবে, পুরুষমাত্রই বিকারগ্রস্ত এবং এক ধরনের অশালীন লোভাতুর দৃষ্টি ছাড়া  অন্য কোনো দৃষ্টিতে তারা নারীদের দিকে তাকাতে পারে না। 

মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বক্তব্যটি অবশ্য যথেষ্ট আপত্তিজনক। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটি নিয়ে বিশেষ দুর্ভাবনা করছি না। যে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মেয়ে আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিলে কোনো উন্মাদও সেটি গুরুত্ব সহকারে নেবে না। 

প্রমত্ত পদ্মা নদীর সামনে কেউ একটা গামছা হাতে দাঁড়িয়ে যদি বলে, সে এই গামছা  দিয়েই পদ্মা নদীর পানিকে আটকে ফেলবে,  তখন কথাটা যে রকম হাস্যকর শোনাবে, এই কথাটাও সে রকম। 

এই দেশের মেয়েদের ওপর আমার অনেক বিশ্বাস।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036730766296387