একটাই দাবি 'জাতীয়করণ' - দৈনিকশিক্ষা

একটাই দাবি 'জাতীয়করণ'

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ ক'দিন ধরে লিখতে বসে কেন যে আগ্রহটা হারিয়ে ফেলি , তা বুঝে উঠতে পারি না । লেখার খেই হারিয়ে যায় । হয়ত লেখালেখিতে কোন ফল মেলে না তাই । লেখালেখি করে কী আর হবে ?  কেউ যদি না পড়ে । কেউ যদি না শোনে । এতটা সময়ই বা কার ?  তবু লিখি । তবু লিখে যেতে হয় । মনের খায়েশে লিখি । আত্মার প্রশান্তির জন্য লিখি ।  

আজ ২৬ এপ্রিল, বৃহষ্পতিবার । ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ । মাউশি'র মহাপরিচালক মহোদয় বেশ ক'জন (সম্ভবত আটচল্লিশ জন নাকি পঞ্চাশ জন) প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তার অফিসে ডেকেছেন । শুনেছি সেখানে বৈশাখি ভাতা, ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, অবসর ও কল্যাণ তহবিলে অতিরিক্ত ৬ শতাংশ কর্তন ইত্যাদি বিষয়ে শলা-পরামর্শ হবে । সঙ্গত কারণে এ উপলক্ষে আজ কিছু লিখার জন্য কিঞ্চিৎ  আগ্রহ বোধ করছি । 

যে সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ডাকা হয়েছে, তারা সবাই নাকি ঢাকা শহরে কর্মরত । তারা  নিঃসন্দেহে  ঢাকা শহরের নামী দামি প্রতিষ্ঠানের প্রধান । সকলে জ্ঞানী-গুণী মানুষ। তারপরেও  কিছু কথা থেকে যায় । আজকের সভায় অন্তত কয়েক জন মফস্বলের প্রতিষ্ঠান প্রধানকেও ডাকা উচিত ছিল । বৈশাখী ভাতা, ইনক্রিমেন্ট ও কর্তন বিষয়ে দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মনোভাব জানার জন্য কেবল ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠান প্রধানরাই যথেষ্ট নন । কারণ ঢাকা শহরের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীগণ প্রতিষ্ঠান থেকে বৈশাখী ভাতা ও ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন । বাড়িভাড়া নেন । পুর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা গ্রহণ করেন। সরকারি হিসেব মতে তারা সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন । বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট না পাবার কষ্টে তারা কতটুকু ব্যথিত, সে নিয়ে সন্দেহ থেকে যায় । সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র ঢাকা শহরের । বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণের বঞ্চনার কষ্ট কতটুকুই বা তাদের স্পর্শ করে কে জানে ? এ কারণে শিক্ষক-কর্মচারীগণের দাবি-দাওয়ার কোন আন্দোলন ঢাকায় জমে ওঠে না বলে অনেকে মনে করেন । 

এ প্রসঙ্গে 'জুতা আবিস্কার' কবিতার সারমর্ম কথাটি মনে পড়ে যায় । রাজা ধুলো-বালির হাত থেকে বাঁচার উপায় বের করতে উজির-নাজির ঢেকে সকলের পরামর্শ চাইলেন । কেউ সারা পৃথিবী ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দিলেন । কেউ পরামর্শ দিলেন সারা পৃথিবী চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে । সবশেষে এক মুচি এসে চামড়া দিয়ে  কেবল পা দু'টো ঢেকে দেবার পরামর্শ দেয় । সে ধারণা থেকেই জুতার আবিস্কার । প্রথমোক্ত পরামর্শ দু'টি কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হলেও শেষোক্ত পরামর্শটি কতই না সহজ ও কার্যকর হয়েছিল । এর সুফল সারা পৃথিবীর মানুষ ভোগ করছে । আমি জানি না, আমাদের ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা মহাপরিচালক মহোদয়কে আজ এমন কোন পরামর্শ দিয়ে বসেন কি না, যা বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে ।

তার ওপর আজকের সভায় যে সকল সম্মানিত প্রতিষ্ঠান প্রধান যোগ দেবেন, তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ-বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট প্রসঙ্গে জাতীয়করণের বিষয়টিও জোরালো ভাষায় তুলে ধরুন । জাতীয়করণ হলে বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের বিষয়টি এমনিতেই ফয়সালা হয়ে যায়। কোন দেন দরবার থাকে না । আর যদি আগে বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতেই হয়, তবে এসবের বকেয়ার হিসাবটি অবশ্যই কষতে হবে । অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে যেভাবে বলা আছে ঠিক সে ভাবে ।  সে সময় থেকে । 

ছয় দফা  দাবি, নয় দফা দাবি । কারো বা এগার দফা । এত দফা, এত দাবি দিয়ে কী হবে ? দাবি একটাই যথেষ্ট। হাজার দাবির এক দাবি । এক দফা-এক দাবি মানলেই সব লেঠা চুকে যায়। সব দফা-সব দাবি তো এই এক দাবির মধ্যেই নিহিত । হাজার সমস্যার সমাধান একটাই। একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেই আর কোন দাবি থাকে না ।  এ কথাটি কাউকে বোঝানো যায় না কেন ?  আর না বোঝার ভান করলে বোঝানোর সাধ্য থাকে কার? সাবেক শিক্ষা সচিব এনআই খান স্যার তো কত ভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে গেছেন। এখনো সময় সুযোগে তিনি বুঝিয়ে লিখে থাকেন । 
কত লেখালেখি হলো । কত স্মারকলিপি গেল। কত মানববন্ধন  আর কত সমাবেশ হলো । কে শোনে কার কথা?  যে দেশে শিক্ষকদের কথা কর্তারা শোনে না সে কেমন আজব দেশ?  যে দেশে জাতি গঠনের কারিগররা রাস্তায় শুয়ে অনশন করেও ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারেন না, সে দেশ সামনে অগ্রসর হয় কী করে ?  বাহ্যিক অগ্রসর হতে দেখলেও এ কোন সত্যিকারের অগ্রগতি নয় । 

এ প্রসঙ্গে আরেকটা ছোট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে যায় । এক চাষীর একটি মাত্র হালের বলদ ।  কোন একটা বিষয়ে সে প্রায় সময় বলত, 'আমাকে অমুক বিষয়টি কেউ বুঝিয়ে দিতে পারলে আমি তাকে হালের বলদটি দিয়ে দেব ।' শুনতে শুনতে তার স্ত্রী একদিন বলল, 'তুমি এ কী বলো? গাঁও-গেরামে কি জ্ঞানী মানুষের অভাব আছে ? কেউ যদি তোমাকে সত্যি সত্যি বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে পারে, তখন তো গরুটি নিয়ে যাবে। তখন আমরা খাব কী করে ?'  কৃষক হেঁসে বলল,  'তুমি আমাকে বোকা মনে কর নাকি ?  কেউ আমাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললেও সব বুঝে শেষে আমি বলব, কিচ্ছু বুঝি নাই । তাতে বিষয়টি আমার বোঝাও হয়ে যাবে আর বলদটিও দেয়া হবে না ।'

সেই কৃষকের ন্যায় আমাদের কর্তা ব্যক্তিগণ ও সব বুঝে না বোঝার ভান করে চলেছেন। আমাদের শিক্ষায় বিদ্যমান বৈষম্য গোটা জাতিকে ছারখার করে দিচ্ছে । শিক্ষার বারটা বাজিয়ে দিচ্ছে । জাতিকে বিভাজন ও বিভক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলছে । শিক্ষার মানে ধ্বস নেমেছে । নোট-গাইডে বাজার সয়লাব হয়েছে । কোচিং বাণিজ্য দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে । প্রশ্নফাঁসের বদনাম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে । মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক অন্ধকার পথে অন্ধের মত হাতড়ে চলেছে আমাদের শিক্ষা । অন্ধ মানুষের হাতে এক প্রজ্জ্বলিত মশাল । এটি দিয়ে অন্ধ মানুষটি তো পথ দেখেই না, বরং এর আগুনে তার জ্বলে পুড়ে মরার আশংকা । আমাদের যেন হয়েছে তাই। 
শিক্ষার মান উন্নয়নে কত সভা হয়। সেমিনার হয়। এ সবে তো কোন লাভ হতে দেখিনি। আসল পথে না হাঁটলে গন্তব্য মেলে কী করে ? হাজারটা ভুল পথে হাঁটলে গন্তব্যে পৌঁছার তো কথা নয়। 

আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ও হয়েছে তা-ই। জাতীয়করণের সহজ পথটি ছেড়ে আমরা কেবল ভুল পথে হাঁটছি। গোটা জাতির আজ তাই দাবি একটাই। সেটি সব স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ। 

লেখক  :  অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ , কানাইঘাট , সিলেট এবং দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক। 

 

 

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041899681091309