সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের ইভটিজিংয়ের বিষয় আমলে না নিয়ে উল্টো সে ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশকারী ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি যশোরে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল রায়পাড়ায় তার পৈত্রিক বাড়িতে সোমবার অভিযানের খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও আশপাশের মানুষ এ বিষয়ে তথ্য দিয়েছে।
তবে এ বাড়িতে তিনি নেই বলে স্থানীয়রা দাবি করে বলেছেন, মাস ছয়েক আগে তিনি এ বাড়িতে এসেছিলেন। আর নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে চাঁদ রাতেও যশোরে গ্রামের বাড়িতে ফোন করেছিলেন বহুল সমালোচিত ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। রংপুর থেকে করা সেই ফোনের পর পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি তিনি। তার তৃতীয় ভাইয়ের স্ত্রী রেকসোনা খাতুন এ তথ্য দিয়ে বলেন, মাস ছয়েক আগে বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর পর আর বাড়িতে আসেননি মোয়াজ্জেম।
যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল রায়পাড়ায় দ্বিতল এই বাড়িটিতে ওসি মোয়াজ্জেমের ছোট দুই ভাই ও একমাত্র বিবাহিত বোন বর্তমানে মায়ের সঙ্গে এখানে থাকছেন। এখানে মোয়াজ্জেমের স্ত্রী-সন্তানদের কেউ থাকেন না। তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওসি মোয়াজ্জেমের বাবার নাম খন্দকার আনসার আলী। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। তার এক ভাই সৌদি আরবে ও আরেক ভাই আমেরিকা প্রবাসী। মোয়াজ্জেম এই বাড়িতে থেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। তবে চাকরিতে প্রবেশের পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে তার। রেকসোনা আরও জানান, তার শ্বশুরের আদি বাড়ি ঝিনাইদহে। যশোর সদরের পুলেরহাটেও একটি বাড়ি আছে তাদের। তবে সেটা ভাড়া দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে বিচার প্রত্যাশায় স্থানীয় থানায় গেলে সহযোগিতার বদলে সে ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে তাকে হয়রানি করেন ওসি মোয়াজ্জেম। তখন তিনি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় আসামিরা আরও সাহসী হয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। এছাড়াও নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন তখনও আসামিদের গ্রেফতার না করে মামলা দায়ের বিলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে।
৮ এপ্রিল নুসরাতের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় কোনো আসামি ছাড় পাবে না ঘোষণা দিলে ওসি মোয়াজ্জেমের ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ সামনে চলে আসে। এরপর গত ১৫ এপ্রিল সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করেন। ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের পর আদালতে মামলার বাদী তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘নুসরাত হত্যাকাণ্ডে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। একই অভিযোগে গত ২৭ মার্চ নুসরাতের মা ওই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
ওই দিনই সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর নুসরাতকে থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে জেরা করাসহ তা ভিডিওতে ধারণ করেন। পরে ওই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়, যা সারাবিশ্বের মানুষ দেখেছে। যদি নুসরাত বেঁচে থাকতেন, তাহলে এরকম ঘটনার পর তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত। থানার একজন ওসির রুমে একজন ভিকটিমকে এভাবে জেরা করা ও ভিডিও ধারণ করে সম্প্রচার করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ।’ তবে এরপরেও চাকরিতে বহাল ছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। ফেনীর সোনাগাজী থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং রংপুর রেঞ্জে তাকে সংযুক্ত করা হয়। রংপুর রেঞ্জে যোগ দিলেও ঈদের পর তাকে আর খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
তবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি অপূর্ব হাসান ওসি মোয়াজ্জেমের বাড়ির খোঁজখবর নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই।
মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আলোচনায় আসা সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাকে গ্রেফতার করতে ফেনী পুলিশের একটি টিম এখনও ঢাকায়। পুলিশ জানায়, যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। এদিকে সাবেক এই ওসির বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন জানান, আগামী ১৬ জুনের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা না হলে বা আত্মসমর্পণ না করলে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হবে।