ঘটনা-১ : গত ২০ আগস্ট টাঙ্গাইল পৌর এলাকার কেন্দ্রীয় গোরস্থান মসজিদ দারুস সুন্নাহ এতিমখানা মাদরাসার ১০ বছরের এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেফতার হন প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক শিক্ষক হাফিজুল ইসলাম (৩০)। টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলার এজাহারসূত্রে জানা যায়, প্রায় আট মাস আগে ওই ছাত্রকে তার বাবা এ আবাসিক মাদরাসায় ভর্তি করেছিলেন। এরপর থেকেই ছেলেটির ওপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। কাউকে কিছু বললে ছাত্রকে খুন করে ফেলার হুমকি দিতেন শিক্ষক হাফিজুল। মাঝেমধ্যেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদরাসা ছেড়ে পালিয়ে যেত ছাত্রটি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই ওই শিশু ছাত্র পুরো ঘটনাটি তার মাকে খুলে বলে। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাঈদুর রহমান রিমন ও শামীম আহমেদ।
ঘটনা-২ : গত ৫ জুলাই ১০ বছর বয়সের এক ছাত্রীকে অফিস রুমে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টাকালে হাতেনাতে ধরা পড়েন নেত্রকোনা কেন্দুয়ার আঠারবাড়ি মা হাওয়া (আ.) কওমি মহিলা মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল খায়ের বেলালী। স্থানীয়রা গণপিটুনি দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে অন্তত ৬ শিশু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, ধর্ষণের পর অভিযুক্ত অধ্যক্ষ বেলালী কাউকে কিছু না বলার জন্য কোরআন শরিফ হাতে দিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের শপথ করাতেন। হোস্টেলে থাকা অপ্রাপ্ত বয়সের ছাত্রীদের যখন-তখন ডেকে নিতেন গা-হাত-পা টিপে দিতে। এক পর্যায়ে সেই অবুঝ শিশুকে ধর্ষণ করতেন।
ঘটনা-৩ : নারায়ণগঞ্জের এলাকার দারুল হুদা আল ইসলামিয়া মহিলা মাদরাসা ও এতিমখানার চার ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩৪) গত ২৭ জুলাই আটক করে র্যাব। এর কিছুদিন আগে ৪ জুলাই ফতুল্লার মাহমুদপুর বায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদরাসায় এক ডজনেরও বেশি শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল আমিন র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। এত গেল মাত্র কয়েকটি ঘটনা। বিশেষ করে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দায়েরের ঘটনায় গত ৬ এপ্রিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এমন নৃশংস ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এক শ্রেণির নীতিবিবর্জিত লম্পট শিক্ষকের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বার বার বিতর্কের মুখে পড়ছে মাদরাসা শিক্ষা। শিক্ষক নামের এসব নরপশুর পৈশাচিকতা থেকে সন্তানতুল্য ছাত্রীরাই নয়, রেহাই পাচ্ছে না শিশু-কিশোর ছাত্ররাও। শুধু ধর্ষণ, বলাৎকার বা যৌন হয়রানিই নয়, অনেক সময় প্রমাণ লুকাতে হত্যা করা হচ্ছে ওই শিক্ষার্থীকে। এই পরিস্থিতিতে সন্তানকে মাদরাসায় পড়াতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন অভিভাবকরা। অনেকেই মাদরাসা ছাড়িয়ে শিশুসন্তানকে নতুন করে স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। পৈশাচিকতার সীমা ছাড়ানো কিছু ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করার কারণে বিচারের আলো দেখলেও অধিকাংশ ঘটনা প্রকাশ্যেই আসছে না। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ করে আরও বিপদে পড়ছে ভুক্তভোগীর পরিবার।
তবে শিক্ষক নামের এসব নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান দেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আলেম-ওলামারাও। প্রতিটি মাদরাসায় নজরদারি বাড়ানোর দাবি করেছেন তারা। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকার অধ্যাপক মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী বলেন, অপরাধী যেই হোক তার কঠোর শাস্তি হতে হবে। এক বা গুটিকয় নৈতিকতাবিবর্জিত ব্যক্তির কারণে এত বড় একটা শিক্ষাব্যবস্থা কলঙ্কিত হতে পারে না। এসব শিক্ষককে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ বিধান করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না করে।
জানা গেছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বড় একটি অংশ মাদরাসা শিক্ষা। কওমি মিলে শুধু ইবতেদায়ি পর্যায়েই শিক্ষার্থী প্রায় ৩৪ লাখ। দেশের মাদরাসা শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতিষ্ঠানের ধরন ভেদে ২৫ থেকে ৬০ শতাংশ হলেও নারী শিক্ষকের হার খুবই নগণ্য। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশের ৬৫৫৩টি দাখিল মাদরাসায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৯০ জন। সেখানে নারী শিক্ষার্থীই শুধু ৮ লাখ ২২ হাজার ৬৬৫ জন যা মোট শিক্ষার্থীর ৬০ দশমিক ৮২ শতাংশ। তবে নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯৬ জন, যা মোট শিক্ষকের মাত্র ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র মিলে ইবতেদায়ি পর্যায়ে শিক্ষার্থী ২০ লাখ ২৭ হাজার ৪৫৫ জন। নারী শিক্ষার্থী ১০ লাখ ১৫ হাজার ২৪১ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশের বেশি। তবে এখানে নারী শিক্ষকের হার মাত্র ১৮ শতাংশ। একইভাবে কওমি মাদরাসায় ইবতেদায়ি পর্যায়ে শিক্ষার্থী প্রায় ১৪ লাখ। নারী শিক্ষার্থী ২৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। নারী শিক্ষক ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মাদরাসাগুলোতেই বেশিরভাগ যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা পরীক্ষায় ফেল করানো বা সর্বোচ্চ নম্বর পাইয়ে দেয়া, অভিভাবকদের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছাত্রীদের হেনস্তা করা, বই-খাতার মধ্যে নগ্ন দৃশ্যাবলি, চটিবই বা কল্পিত প্রেমপত্র গুঁজে দিয়ে তা আবিষ্কার করা ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলছে। কখনো নিজেকে মহান প্রমাণ করে ছাত্রীকে নিজের প্রতি দুর্বল করে তুলেছে। পিতৃতুল্য শিক্ষকদের এসব জঘন্য কর্মকাণ্ডে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি বিব্রত আদর্শবান শিক্ষকরা। বেশিরভাগ ঘটনা স্থানীয় পর্যায়ে মীমাংসা ও ধামাচাপা পড়ে যায়। শিক্ষকদের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেও কোনো সুরাহা পান না ছাত্রীরা। বরং নানা কৌশলে অভিযোগকারী ছাত্রীদেরই হেনস্তা করা হয়। অভিযোগকারী ছাত্রী স্কুল ও নিজ গৃহে প্রচণ্ড মানসিক চাপের শিকার হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার শিক্ষাজীবনেরও ইতি ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই নিজের সব গ্লানির চিরসমাপ্তি ঘটায় ভুক্তভোগী ছাত্রী। চলতি বছরেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, জয়পুরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মাদরাসাছাত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যদিও সব আত্মহত্যার পেছনের কারণ জানা যায়নি।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালের খবর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক বছরে মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক কর্তৃক কয়েকশ ধর্ষণ, বলাৎকার ও যৌন হয়রানির ঘটনা সামনে এসেছে। এ সময় নারায়ণগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন ‘সিরিয়াল ধর্ষক মাদরাসা শিক্ষকের’ সন্ধানও মিলেছে। তাদের কেউ কেউ তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পড়ুয়া ডজনেরও বেশি ছাত্রীর ওপর মাসের পর মাস পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে অবশেষে ধরা পড়েছেন। বলাৎকারকে কেন্দ্র করে অন্তত চারজন শিশু-কিশোর ছাত্রকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বর্বরতার ফাঁদে এখনো আটকে আছে অসংখ্য ছাত্রী। ধর্ষক শিক্ষকদের লালসায় বহু শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, চুরমার হয়ে গেছে সব স্বপ্ন। অনেকেই আত্মহননের মাধ্যমে মুক্তির পথ খুঁজেছে।
গত জুনে ৬ বছর বয়সী এক মাদরাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে আটক হন সাভার পৌর এলাকার গেন্ডা মহল্লার একটি বালিকা মাদরাসার শিক্ষক ইদ্রিস আলী। কান্নাকাটি করায় ওই শিক্ষকের হাত থেকে সে যাত্রায় বেঁচে যায় শিশুটি। গত ১ মে যশোরের শার্শা উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি এবং সহায়তার অভিযোগে বাগআঁচড়া সাতমাইল মহিলা আলিম মাদরাসার সুপারসহ চার শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। মে মাসে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের মদিনা একাডেমি নূরানি মাদরাসায় ১১ বছরের এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেফতার করে পুলিশ। এপ্রিলে রাজশাহীর পুঠিয়ায় শিলমাড়িয়ার মাদরাসায় এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক আরিফুল ইসলাম (২৫) গ্রেফতার হন। একই মাসের ১৫ তারিখ ফেনীর দাগনভূঞায় ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শহীদুর রহমান নামে এক মাদরাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পরদিন ১৬ এপ্রিল ফেনী সদরের আরেক মাদরাসার শিক্ষক মো. হারুন একই অভিযোগে গ্রেফতার হন। ২৩ এপ্রিল আবারও তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে দাগনভূঞায় আবদুর রহমান (৩০) নামের আরেক মাদরাসা শিক্ষক গ্রেফতার হন। গত জুলাইয়ে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ৮ বছরের এক শিশুকে বলাৎকারের চেষ্টার অভিযোগে মোহাম্মদ ফোরকান (২৬) নামে এক মাদরাসা শিক্ষক গ্রেফতার হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান, যিনি মাদরাসায় যৌন নির্যাতনের বিষয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, মাদরাসাগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেখানে এত বেশি নারী শিক্ষার্থী পড়ছে, সেখানে নারী শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। এটা বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া মাদরাসাগুলোকে নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ করার মতো শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। মাদরাসা বোর্ডের অভিভুক্ত নয় অনেক মাদরাসা। সেসব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি হলেও দেখার কেউ নেই। এ ছাড়া আইনেও ফাঁক আছে। অনেক ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়। এগুলোও ধর্ষণ। তবে আইনে সেগুলো ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়ে না।