প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশব্যাপী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সরকার। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সার জন্য রাজধানীতে ৪০০ বেডের হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় প্রস্তুত রয়েছে ১০০ বেড। প্রত্যেক উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পৃথক কর্নার করা আছে। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় এ তথ্য জানানো হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি। করোনা মোকাবিলায় দেশের স্বার্থে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন। একই সঙ্গে প্রবাসীদের এখন দেশে না আসার আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জাতীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চীন, কোরিয়া, ইতালি ও ইরান থেকে কেউ দেশে আসলে তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। মঙ্গলবার (১০ মার্চ ) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবুল খায়ের।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, জাতীয় কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কী করণীয় সে ব্যাপারে সবাই দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে প্রস্তুতি চলছে। এ পর্যন্ত ৫০ লাখ মানুষকে স্ক্যানিং করা হয়েছে। সম্প্রতি ছয়টি অত্যাধুনিক থার্মাল স্ক্যানার আনা হয়েছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতেও স্ক্যানার বসানো হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে আগামী দুই দিনের মধ্যে সারা দেশে পোস্টার-ব্যানার পৌঁছে যাবে। ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জনসমাগম এগিয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, খেলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে। এছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আফিস, আদালতসহ সর্বক্ষেত্রে স্ব স্ব উদ্যোগে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সাবান ও হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল চলবে স্বাভাবিক নিয়মে। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় কমিটির বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল হক, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, স্বাচিপের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান, বিএমএর মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে ঘরে ঘরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাহলে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিন জন রোগী সনাক্ত হয়েছে বলে রবিবার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ সম্প্রতি ইতালির দুটি শহর থেকে দেশে ফিরেছেন। আর তাদের এক জনের সংস্পর্শে এসে পরিবারের আরেক নারী সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের সবার অবস্থাই স্থিতিশীল এবং তিন জনকেই হাসপাতালে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে বলে গতকাল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর জানিয়েছে। ওই দুই জনের সংস্পর্শে আসা আরো তিন জনকে আইসোলেশনে এবং এক জনকে হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। অপরদিকে বাংলাদেশে যে তিন জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের এক জনের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ৪০ জনকে তাদের বাড়িতেই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এছাড়া ইতালি ও স্পেন থেকে আসা আরো দুই জনকে হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল হক। তিনি বলেন, মানুষ সচেতন হলে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আছে। এই আশঙ্কা রোধের জন্য আমরা ব্যবস্থাও করেছি।
বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিংয়ে শিথিলতার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সচিব বলেন, ‘এই ভাইরাসের প্রকৃতিটা একটু জানা দরকার। ভাইরাস যদি থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আসবে না, ধরা পড়বে না বা উপসর্গ দেখা দেবে না। ১৪ দিন পর্যন্ত এটা উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে। যখন উনি দেশে এসেছেন কোনো উপসর্গ ছিল না। এটা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। স্ক্যানিংয়ে তার জ্বর ধরা পড়বে না- তাই যে কেউ চলে আসতে পারবে। আমরা ব্যবস্থা করেছি যে, তাদের (বিদেশ ফেরতযাত্রী) একটা লোকেটর ফর্ম দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সে কোথায় থাকবে কীভাবে থাকবে সেটা লেখা থাকবে। যদি কোনো উপসর্গ দেখা দেয় সে যোগাযোগ করবে। এর ভিত্তিতে মোবাইল ট্র্যাক করি, কোন দেশ থেকে এল, কোথায় আছে—তারাও যোগাযোগ করে হটলাইনে যে, জ্বর আসছে, কাশি হচ্ছে। এভাবে আমরা ১০০ জনের মতো লোককে টেস্ট করেছি। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আসা দুই জনের শরীরে ধরা পড়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বিদেশ ফেরতদের সঙ্গে করোনা ভাইরাস নিয়ে অস্বাভাবিক ধরনের কোনো আচরণ করবেন না। বাড়িওয়ালাদেরও বলব, আপনারা তাদের বাড়িতে থাকতে দিন, না হলে এটি আরো বেশি ছড়াবে।
মাস্কের দামে আগুন, চিকিত্সকরা বলছেন ‘প্রয়োজন নেই’
বিশ্বে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মাস্কের চাহিদা বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন সব ধরনের মাস্কের দাম। যদিও চিকিত্সকরা বলছেন, সবার মাস্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। শুধু যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের সংস্পর্শে গেলেই অন্যদের সংক্রমণের ভয় আছে। সংক্রমণের শিকার রোগীকেই শুধু মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সুস্থ মানুষের মাস্ক ব্যবহারের দরকার নেই। অযথাই মানুষ মাস্ক কিনতে ছুটছেন। এ কারণে খামোখা শুধু দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মাস্ক প্রয়োজন ডাক্তার-নার্সদের যারা সেবা প্রদান করবেন। গতকাল সকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সরবরাহ কম থাকার অজুহাত দিয়ে ১০-১২ গুণ বেশি দামে মাস্ক বিক্রি করা হচ্ছে। দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সার্জিক্যাল, কাপড়ের ও ফিল্টার মাস্কের কয়েকগুণ বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে মাস্কের সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, করোনা ভাইরাসকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছেন। এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পাঁচ টাকার জিনিস মুহূর্তেই ৬০ টাকা হয়ে যায়।
সাত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মূল্য নির্ধারণ করে দিল ওষুধ প্রশাসন
দেশে হ্যান্ড স্যানিটাইজার উত্পাদনকারী সাত ওষুধ কোম্পানির উত্পাদিত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান জানান, বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে হ্যান্ডসেট বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।