কলেজ জাতীয়করণ ও ক্যাডার সমস্যা - দৈনিকশিক্ষা

কলেজ জাতীয়করণ ও ক্যাডার সমস্যা

মোহাম্মদ মহসিন |

সরকারি কলেজ নেই, এমন সব উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কলেজ শিক্ষায় তাঁর এ সিদ্ধান্ত খুবই প্রজ্ঞাপূর্ণ, সুদূরপ্রসারী ও ইতিবাচক।

তাঁর সে লক্ষ্যকে আরো পরিষ্কার করা হয়েছে জাতীয় সংসদে পাস করা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ। শিক্ষানীতির শিক্ষাপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৭ নম্বর অধ্যায়ের ‘মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা’ অংশের ৯ নম্বর কৌশলে বলা হয়েছে, ‘যেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ নেই সেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, এমন এক হাজার ৫০০ গ্রামে নতুনভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প চলমান। সে ধারাবাহিকতায় সরকারি কলেজ নেই, এমন প্রায় ৩০০ উপজেলায় নতুন অবকাঠামোসহ সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত অনুমিত ছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উপজেলার একটি করে বেসরকারি কলেজকে জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া চলমান, তা মোটেই সুফলদায়ক হবে না বলে প্রাজ্ঞজনের মত।

জাতীয়করণের ক্ষেত্রেও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সুস্পষ্ট ধারা আছে। ২৭ নম্বর অধ্যায়ের ‘মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা’ অংশের ৮ নম্বর কৌশলে বলা আছে, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এই নীতিমালায় জাতীয়কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিসংক্রান্ত বিধান থাকবে, যাতে কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। ’ কিন্তু ২০১০ সালে পাস হওয়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কোনো আইন এখনো তৈরি না হওয়ায় সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত পন্থায় জাতীয়কৃত কলেজশিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তি অব্যাহত আছে, যা সরকারি নীতির পরিপন্থী শুধু নয়, বরং ক্যাডার রিক্রুুটমেন্ট রুলস ১৯৮১-এর চূড়ান্ত বরখেলাপ।

বাংলাদেশের শাসন বিভাগের সেবাগুলোর উচ্চমান অর্জনের লক্ষ্যেই ক্যাডার সার্ভিসের (বিসিএস) সূত্রপাত। সমগ্র সেবা খাতে কাঙ্ক্ষিত ও উঁচু পেশাদারি সৃষ্টির লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে ক্যাডারের সৃষ্টি হয়, যার সর্বশেষ সংখ্যা ২৮। এই ২৮ ক্যাডারে নিযুক্ত কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বলেই সর্বোচ্চ মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্নদের ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের চেষ্টা করা হয়। সে কারণেই ক্যাডার সার্ভিসকে খুব মর্যাদার চাকরি মনে করা হয় এবং মেধাবীদের প্রথম দিকের আকর্ষণ থাকে এই চাকরিতে প্রবেশের। এ রকম মেধাবী ও যোগ্যদের দলে যদি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাছ-বিচার ছাড়াই এক দলকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে জাতি মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে নিশ্চিত। শিক্ষা খাতে এ রকমটা হলে সে ক্ষতি আরো দীর্ঘমেয়াদি। অথচ বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।

শিক্ষা ক্যাডার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে যদি বিসিএস ছাড়াই হাজার হাজার ‘হঠাৎ ক্যাডার’ যোগ হয়, সেটা সরকারের লক্ষ্য অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে এ রকম ‘হঠাৎ ক্যাডার’দের কারণে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি শঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। কারণ তাঁরা গুণগত মানে যেমন কাঙ্ক্ষিত স্তরের নন, তেমনি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে তাঁদের বেশি মনোযোগ বিধিবহির্ভূতভাবে সুবিধা ও পদ-পদবি দখলে। এ রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। অন্যদিকে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করার পরও বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ১৭-১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, যদিও তাঁদের নিয়োগ শুধু শিক্ষকতা পেশার জন্য; কিন্তু শিক্ষকতার চেয়ে অশিক্ষক ও প্রশাসনিক পদে তাঁদের আগ্রহ বেশি। ক্যাডারভুক্তির সুযোগে বর্তমানে ৩১৫টি সরকারি কলেজের মধ্যে প্রায় ২২২টি কলেজের অধ্যক্ষ পদে আছেন জাতীয়কৃত শিক্ষকরা। এ ধরনের বঞ্চনার ফলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজ দায়িত্বে শতভাগ ভূমিকা রাখতে পারছেন না; যার অবধারিত পরিণতি শিক্ষার বিপর্যয়।

সরকার মানসম্মত শিক্ষা স্বল্প খরচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই সরকারি কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় করলেই বেসরকারি কলেজের শিক্ষক দ্বারা সরকারের প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়া কিভাবে সম্ভব?

যোগ্য ও মানসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব নয়। সরকারি কলেজে সরকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এমন শিক্ষক নিয়োগ দেয় যাঁরা বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত। পূর্বোক্ত প্রক্রিয়ায় এসব শিক্ষকের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত বলেই অভিভাবক মহলের বিশ্বাস। তাই তারাও সরকারের কাছে এমন শিক্ষক প্রত্যাশা করে। কিন্তু সরকারি কলেজে সেই এমপিও শিক্ষক অভিভাবকদের কাছে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ প্রবাদের মতো।

অন্যদিকে হাজার হাজার ‘হঠাৎ ক্যাডার’ অন্তর্ভুক্তিতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অকল্পনীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসে আসতে চাইবে না। তখন শিক্ষাক্ষেত্র অযোগ্য আর অমেধাবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে। তারা জাতির শিক্ষাকে কোন স্তরে নিয়ে যাবে সেটা ভাবলে শিহরিত হই।

জাতীয়কৃতদের ক্যাডারভুক্তি বন্ধ করে এ সংকট রোধ করা যায়। তাঁদের নিয়োগ, মর্যাদা, বদলি, পদোন্নতি সব কিছুকে নতুন আইনের দ্বারা পৃথক করতে হবে। সাবেক শিক্ষাসচিব এন আই খানের মতে, ‘জাতীয়কৃতদের শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি অনৈতিক। ’ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইনের মতে, ‘বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ও উচ্চ মর্যাদা পাওয়া উচিত। ’ সরকারীকরণের পর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ক্যাডার মর্যাদা না পেলে তাঁদের ক্ষতি কী? তাঁদের ক্যাডারের বাইরে রাখার দাবি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিছক ইগোর কারণে নয়, বরং উচ্চশিক্ষাকে মহাসংকটের হাত থেকে বাঁচাতে। ভবিষ্যতে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের পথ বন্ধ হলে জাতির সংকট অনিবার্য। শিক্ষার এই সংকট থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে সরকার—এমন প্রত্যাশা সবার।

লেখক : বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা।

সৌজন্যে: কালেরকন্ঠ, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭। 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058810710906982