ইংল্যান্ড আর কলম্বিয়ার মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শেষ হলো রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা। ১৬ দলের মধ্য থেকে আটটি ম্যাচের মাধ্যমে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে এসেছে ৮টি দল। আবার বাদ পড়েছে আর্জেন্টিনা বা পর্তুগালের মতো বিশ্বখ্যাত তারকাদের দলও। জেনে নেওয়া যায় কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আগে কে কীভাবে জয়-পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
রাশিয়া
বিশ্বকাপের ইতাহাসে উদ্বোধনী ম্যাচে হারার ইতিহাস নেই স্বাগতিকদের। সে ইতিহাস বদলায়নি এবারও। বরং রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিকরা বেশ নাকানি-চুবানিই খাইয়েছে প্রতিপক্ষ সৌদি আরবকে। উদ্বোধনী ম্যাচেই ৫-০ গোলের বড় জয় পায় দলটি। এরপর মিশরের জালেও জড়িয়েছে ৩ গোল। সব মিলিয়ে গ্রুপ 'এ' তে রানার্স আপ হয়ে শেষ ১৬ নিশ্চিত করে দলটি। আর সবশেষে গ্রুপ 'বি' এর চ্যাম্পিয়ন ও বিশ্বকাপের অন্যতম দল স্পেনকে হারিয়ে নিজেদের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে দলটি। গোলরক্ষক ইগর আকিনফিভ টাইব্রেকে স্পেনের দু’টি পেনাল্টি ঠেকিয়ে রাশিয়াকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। রাশিয়ার মতো র্যাংকিং-এ ৭০ নম্বরে থাকা একটি দলের পক্ষে এ জয় কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়ে অবশ্য কথাবার্তার শেষ নেই ফুটবল বিশ্বে।
উরুগুয়ে
শেষ ১৬-তে পর্তুগালের বিপক্ষে দলের ২-১ ব্যবধানের জয়ে দু’টি গোলই করেন উরুগুয়ের কাভানি। দলকে বিশ্বকাপে তুলতে বাছাই পর্বে ১৫ ম্যাচে করেন ১০ গোল। ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে এদিনসন কাভানিকে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন উরুগুয়ের ফরোয়ার্ড লুইস সুয়ারেজ। তবে তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, কাভানিকে ছাড়াই মানিয়ে নিতে পারবে তার দল। আর ঠিক এমন একটি দল নিয়েই এবার মাঠে নেমেছে গ্রুপ 'এ' এর চ্যাম্পিয়নরা। গ্রুপ পর্বে মিশর ও সৌদি আরবকে ১-০ গোলে এবং স্বাগতিক রাশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শেষ ১৬ নিশ্চিত করে উরুগুয়ে। এরপর নকআউট পর্বে পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিশ্চিত করে দলটি। আবেগী ফুটবলপ্রেমীরা এখন ভাবতেই পারেন, অলক্ষ্যে থাকলেও এবারের বিশ্ব আসরে নিজেদের অলক্ষ্যে রাখতে চাইছেন না ক্ল্যাসিক এডিনসন কাভানির দল।
ফ্রান্স
নকআউট পর্বে দ্বিতীয় গ্রুপের খেলায় আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়ে শেষ আটে উঠে এসেছে ফ্রান্স। এর আগে জয় দিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে ১৯৯৮ সালের শিরোপাজয়ীরা। তবে প্রতিটি ম্যাচেই জিততে হয়েছে ঘাম ঝরিয়ে। অ্যান্তোনিও গ্রিজম্যান ও পল পগবা বারবার আগলে রেখেছেন নিজেদের দল। গ্রপ 'সি' এর শীর্ষে থাকা দলটির বর্তমান ফিফা র্যাংকিংয়ে আছে ৭ এ। গতবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া দলটি এবার খুব করেই চাইবে নিজেদের ঘরে সর্বোচ্চ সম্মানটা তুলে নিতে।
ব্রাজিল
নেইমার নৈপুণ্যে মেক্সিকোকে হারিয়ে শেষ আটে পৌঁছে গেছে ব্রাজিল। শেষ ১৬-তে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ব্রাজিল জিতেছে ২-০ গোলে। সময়ের সেরা তারকাদের মধ্যে দ্বিতীয় রাউন্ডে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো না পারলেও সে কাজটা করে দেখিয়ে দিয়েছেন নেইমার। কোচ তিতের তত্ত্বাবধানে অবশ্য সবসময়ই একটা গোছানো খেলা উপহার দিয়েছে গ্রুপ 'ই' এর এই চ্যাম্পিয়নরা। গ্রুপ পর্বে সার্বিয়া ও কোস্টারিকাকে ২-০ গোলে হারিয়ে এবং সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে দ্বিতীয় পর্বে আসে তিতের দল। হেক্সা মিশনে এগিয়ে যাওয়ার পথে অঘটনের এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল অবশ্য শেষ আটে পা রেখেছে বেশ নিরাপদেই।
ক্রোয়েশিয়া
১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত চলে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়া। ডেভর সুকার জিতেছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। ক্রোয়েশিয়ার হঠাৎ এ উত্থানে তখন হতবাক হয়েছেন অনেক ফুটবলবোদ্ধা। তবে হ্যালির ধূমকেতুর মতো হঠাৎ উদয় হয়ে আবার যেন অস্তাচলে হারিয়ে যায় দেশটি। ফিফা র্যাংকিংয়ে বরাবরই ওপরের দিকে অবস্থান; কিন্তু মাঠের খেলায় উজ্জ্বল না হলেও বিশ্বকাপে অন্যতম শক্তিশালী একটি দল হিসেবেই পরিচিত ক্রোয়েশিয়া। আর সে শক্তির পরিচয়ই যেনো রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-০, আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ এবং নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়। এছাড়া নকআউট পর্বের দারুণ রোমাঞ্চকর ম্যাচে ডেনমার্ককে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেছে দলটি। শেষ ম্যাচের ইতিহাস থেকে তাই বলায় যায়, লক্ষ্য ভেদ করে টিকে থাকতে একটুও পিছপা হবে না এবারের ক্রোয়েশিয়া।
বেলজিয়াম
এবারের আসরের অন্যতম ফেভারিট দল বেলজিয়াম। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে বলছেন, সোনালি প্রজন্ম নিয়ে গড়া দলটি ফাইনালেও খেলতে পারে। শেষ ষোলোর ম্যাচে জয়ের সুবাদে ষষ্ঠ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বেলজিয়াম। এর আগে ব্রাজিল, ফ্রান্স, উরুগুয়ে, রাশিয়া ও ক্রোয়েশিয়া শেষ আটে জায়গা করে নেয়। শেষ আটে অবশ্য শিষ্যদের শুধু খেলা উপভোগের পরামর্শ দিয়েছেন বেলজিয়াম কোচ মার্তিনেস। প্রত্যাশার চাপ না থাকার কথাও জানিয়েছেন তিনি। আর এ প্রত্যাশা না থাকা বা শুধু উপভোগটাই হয়ে যেতে পারে অনেক বড় উপভেগের উৎস। কেননা, কোচের সঙ্গে সুর মেলাননি ফরোয়ার্ড তমা মুনিয়ে। দারুণ লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতিতে তার কথা, ‘এখনই অথবা কখনও নয়’। এর আগে ইংল্যান্ড, তিউনিসিয়া ও পানামাকে হারিয়ে গ্রুপ 'এইচ' এর চ্যাস্পিয়ন হয় দলটি। আর দ্বিতীয় পর্বে জাপানকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে সোনালি প্রজন্ম।
সুইডেন
সুইজারল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রেখেছে সুইডেন। এর থেকে বরং ‘সুইস’ নাইফকে ভোঁতা বানিয়ে কোয়ার্টারে সুইডেন বললেই বেশি সন্তুষ্টি আসবে অনেক দিন পরে শেষ আটের চৌকাঠে পা রাখা সুইডেনের সমর্থকদের মনে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়ার পর আর কখনোই গ্রুপপর্ব পেরোতে পারেনি সুইডেন। অবশ্য শেষ ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে তো খেলতেই পারেনি তারা। এবার তো গত এক যুগের সবচেয়ে বড় তারকা ইব্রাহিমোভিচকে ছাড়াই এসেছিল। আর সে দলই কিনা প্রত্যাবর্তনেই পৌঁছে গেলো কোয়ার্টার ফাইনালে! তাই পরবর্তী ম্যাচগুলোও যেন নিজেদের হাতে থাকে, সে কথা মাথা রেখেই পরবর্তী ম্যাচগুলোতে মাঠে নামবে দলটি। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়াকে ১-০ এবং মেক্সিকোকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। আর তাদের জন্য মতো বিষয় এই যে, বল দখলের লড়াইয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও, প্রতি আক্রমণে গোলের সুযোগ তারাই বেশি তৈরি করেছে এ বিশ্বকাপের আসরে।
ইংল্যান্ড
বেলজিয়ামের কাছে হার ছাড়া সবই সাফল্য ইংল্যান্ডের। দলের সেরা খেলোয়াড় হ্যারি কেন জ্বল জ্বল করছেন। বলা যায় গোলমেশিনে পরিণত হয়েছেন তিনি। আর এ গোলমেশিন নিয়েই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হাজির যেকোনো দলকে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা সাউথগেট। এর আগে গ্রুপ পর্বে পানামাকে ৬-১ গোলে হারিয়ে দলটি জানান দিয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব। এরপর তিউনিসিয়া এবং শেষ ১৬-তে সুইডেনকে হারিয়ে বিশ্বকাপের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো তারা। ফর্মে থাকা হ্যারি কেন ও দলের সাফল্যে ফাইনালের স্বপ্ন দেখছেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক ওয়েন রুনি। আর রাহিম স্টারলিং, মার্কাস র্যাশফোর্ডের মতো তরুণ ফুটবলার তো আছেই। সব মিলিয়ে তরুণ দলটা এবার ছুটছে ভালো।