গণতন্ত্রের সেবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী - দৈনিকশিক্ষা

গণতন্ত্রের সেবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান |

যুগের প্রয়োজনে ভারতীয় উপমহাদেশে উনবিংশ শতাব্দীতে এমন কয়েকজন মহামানবের আবির্ভাব হয়, যাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনন্য ত্যাগের বিনিময়ে এই ভূখণ্ড সুদীর্ঘ দু’শতাব্দীর বৃটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়। জননন্দিত দেশপ্রেমিক এসব মহামানবের অন্যতম হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক, বিচক্ষণ আইনবিদ, নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক ও এ উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবস। এই মহান নেতা তাঁর নিঃস্বার্থ ও বলিষ্ঠ কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। 

১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেদিনীপুরে জন্মলাভ করেন। কলকাতা মাদরাসায় বাল্যশিক্ষা শেষ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন এবং তারপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশ গমন করেন। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ বিএসসি ও বিসিএল ডিগ্রি লাভ করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইংরেজি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে স্বদেশে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিখ্যাত সুহরাওয়ার্দী তরিকার পীরবংশের সন্তান। তাঁর পিতা স্যার যাহিদ সোহরাওয়ার্দী ও মাতা খুজিস্তা আখতার বানু-উভয়েরই পূর্বসূরিরা সাধক, পণ্ডিত, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক নেতা ও ধর্মপ্রচারক হিসাবে ইতিহাসে বিখ্যাত।

বিদেশে অবস্থানকালেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, শোষণহীন সমাজ গঠন করে দেশের নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও তাদের সুখী সমৃদ্ধ জীবন পরিচালনার লক্ষ্যই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়, ১৮৫৭-র স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপর্যয়ের ফলে এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এদেশের মুসলমানেরা যখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে নির্যাতিত মানুষের মুক্তিদাতার ভূমিকায় তিনি আবির্ভূত হন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। সোহরাওয়ার্দীর সমগ্র জীবন ছিল জনগণের সঙ্গে একত্রে গ্রথিত। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সঙ্গে নিজের জীবনকে নিঃশেষে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করার জন্যে, তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আজীবন তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা। সব সময় নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের জন্যে তাঁর কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাঁকে প্রচুর লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে তাঁর জীবনে অনেক বিপর্যয় এসেছে এবং তিনি তা হাসিমুখে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। রাজনীতি ও দেশ সেবার ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল।তিনি অবহেলিত, উপেক্ষিত সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যই পছন্দ করতেন বেশি এবং সে জন্যই দেখা যায়, তিনি শ্রমিকমহলে ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় নিঃস্ব মানুষের মাঝে সুখ-দুঃখের আলোচনায় রত থাকতেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তাঁর সে দিনের জয়যাত্রা জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, জীবনে কোন নির্বাচনেই তাঁকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়নি। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে তিনি সরকারবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন। তখন থেকেই তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং দেশবন্ধু তাঁর প্রতিভা ও গুণে মুগ্ধ হন। তাঁরা উভয়েই হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হন। তাঁদের প্রচেষ্টায় বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) স্বাক্ষরিত ও বাস্তবায়িত হয়। বাংলার মুসলিম নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী এই সময় হতেই পরিচিত হতে থাকেন। মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিটি আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তদানীন্তন মুসলিম ভারতের বিচক্ষণ ও দেশপ্রেমিক নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলীর যোগ্য শিষ্য হিসেবে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।  

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কোয়ালিশন স্বরাজ দলের উপনেতা ও কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র। তিনিই পোর্ট শ্রমিকদের সংগঠিত করে অবিভক্ত বাংলায় সর্বপ্রথম শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ইউনাইটেড পার্টি গঠন করেন এবং পরবর্তীতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরোধে মুসলিম লীগে যোগদান করে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে খাজা নাযীম উদ্দীনের মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তৎকালীন খাদ্য সমস্যার মোকাবিলা করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত হন ও বিজয়ী মুসলিম লীগ দলের নেতা হিসেবে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পর মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মিলে তিনি কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা রোধ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে সে সহিংস অবস্থার মোকাবিলা করেছেন, তা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান বললে ভুল হবে না। 

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলার পক্ষ হতে সে সময় সোহরাওয়ার্দী নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে দেশের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হন। ১৯৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী রিপাবলিকান দলের কোয়ালিশন নেতা হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয় এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত গৌরবময়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী জীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু জীবনের শেষে কিছুই ছিল না তাঁর। সবই তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন। তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে কেউ কোনও দিন নিরাশ হয়নি। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালে যুদ্ধ ও অজন্মাজনিত দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য গ্রামবাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। ধর্মগোলা, লঙ্গরখানা ইত্যাদি প্রবর্তনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জীবন রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে উভয়বঙ্গে ভয়াবহ দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠলে তা প্রশমিত করার জন্যে তিনি শান্তি অভিযান পরিচালনা করেন। এভাবে তিনি মানবতার সেবা করে গেছেন।

মানুষের দুঃখ ও বেদনায় তাঁর কোমল হৃদয়প্রাণ যেমন কাতর হতো, ঠিক তেমনিই আবার কর্তব্য-কর্মে তিনি ছিলেন বজ্রের মতো কঠিন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি এদেশের মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আল্লাহর আশীর্বাদস্বরূপ এসেছিলেন। তিনি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর দুরদেশ বৈরুতের এক হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমানের এই অশান্ত সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর মত গণতন্ত্রপ্রেমী, জনদরদী, ত্যাগী রাজনীতিবিদ ও দক্ষ রাষ্ট্রনায়কের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। গণতন্ত্রের চর্চায় এবং দেশ গঠনে আমরা যেন এই মহান নেতার জীবনাদর্শ অনুসরণ করতে পারি, এই প্রত্যাশাই করি। 


লেখক : প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052151679992676