চীনে দেখা প্রাথমিক শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

চীনে দেখা প্রাথমিক শিক্ষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গ্রামে এক পশলা বৃষ্টির পর রাস্তার পাশে বা বাড়ির আঙিনায় বসে কাদামাটি নিয়ে খেলার সুখস্মৃতি ভুলবার নয়। ছোট্ট শিশু তার সরল মনে কখনও পাখি, কখনও পুতুল, কখনও-বা অন্য কোনো আদলে গড়ে তুলতে চায় তার হাতের কাদামাটির পিণ্ডকে। সহজ-সরল নিষ্পাপ এসব শিশুর মনোজগৎ ঠিক কাদামাটির মতোই নরম। তাকে যে আদলে গড়া যাবে, ঠিক সেই আদলেই গড়ে উঠবে। পরিবারে মা-বাবা, পরিজনের কাছ থেকে শেখা বিষয়গুলো শিশুমনে বিস্তর জায়গা করে রাখে। এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে এসে সে পরিচিত হয় নতুন এক জগতের সঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ এবং শিক্ষকদের শিক্ষা পদ্ধতি তাকে গড়ে তোলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাণ্ডারি হিসেবে। ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা এবং বিদেশ ভ্রমণের সুবাদে জানার চেষ্টা করেছি কোমলমতি এসব শিশুকে গড়ে তোলার কারিগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুমহান দায়িত্ব নিয়ে। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার চীনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কখনও পাঁচ দিন, কখনও দশ দিন বা ২৫ দিনের জন্য বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে চীনে যাওয়ার সুবাদে সেখানকার মানুষের আচরণ, ভাব বিনিময় পদ্ধতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস বিশেষত আচার-অনুষ্ঠান আমাকে বেশ চমৎকৃত করেছে। সময়ে সময়ে ছুটে গেছি দর্শনীয় ও নান্দনিক জায়গা পরিদর্শন করতে। শিক্ষার প্রতি আলাদা অনুরাগ থাকায় জাপানের মতো চীনেও আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খুঁজে ফিরেছি আমার শৈশব, ছাত্রজীবন। ছোট ছোট শিশুর মাঝে হারিয়ে গিয়েছি হয়তো কিছু সময়ের জন্য। মানসম্মত ও গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অপার আগ্রহ থাকায় কেন যেন ভিনদেশের মাটিতেও একটু নতুন কিছু আস্বাদনের ইচ্ছা হয়। তা যদি কিছুটা হলেও আমার দেশের কোমলমতি শিশুদের মাঝে নতুন কিছু দিতে পারে, সে আশায়। বেশ কিছুদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে জাপানের অভিজ্ঞতা শীর্ষক লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ চীনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বসা।

চীনের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কেমন, কীভাবে বেড়ে উঠছে সেখানকার কোমলমতি শিশুরা, শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতিই-বা কেমন ইত্যাদি বিষয় স্মৃতি থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথমে বলে রাখি, চীনের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার আদলে। সেখানে গ্রাম ও শহরে গ্রেড ওয়ান থেকে গ্রেড নাইন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটি শিশু প্রথম ধাপে ভর্তি হয় কিন্ডারগার্টেনে, যা একটা শিশুর তিন থেকে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আবার তিন বছর বয়সের আগে যে শিক্ষা গ্রহণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেটা নার্সারি হিসেবে অভিহিত।

চীনে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি দুই ভাগে বিভক্ত; একটি সরকারি, অন্যটি বেসরকারি। অনেকটা আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের মতো। তবে চীনের অধিকাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে বিধায় সেখানকার কিন্ডারগার্টেন সরাসরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ফলে শিশুরা প্রথম গ্রেডের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন সরকারি অনুদানের বাইরে থাকে। শহরাঞ্চলে অনেক বেসরকারি স্কুল রয়েছে, যা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে অধিক পরিচিত। একটি বিষয় লক্ষণীয়, গ্রামগুলোতে পর্যাপ্ত ফ্যামিলি কেয়ার প্রোগ্রাম থাকলেও সেদেশের শিক্ষা বিভাগ চাচ্ছে গ্রামগুলোতে সরকারি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে শিশুরা সঠিক ও গুণগত শিক্ষা পায়।

এবার আসি চীনে প্রথা ও বিশ্বাস বিষয়ে। যে কোনো দেশের আচার-বিশ্বাস বা প্রথা সেদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে চীনে রয়েছে বেশ কিছু প্রথা। তার মধ্যে অন্যতম 'কনফুসিয়াস নীতি', যেখানে জোর দেওয়া হয়ে থাকে কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তার ওপর। চীনে কোনো পরিবার, হোক দরিদ্র বা ধনী তারা ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং প্রত্যেক বাবা-মার ধারণা, তার সন্তানদের সফলতার শীর্ষে আরোহণের একমাত্র সোপান হলো, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ফল। শিক্ষানীতির কথা যদি বলি, সেটিও বেশ চমকপ্রদ। চীনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দুটি বিষয়ের ওপর সবচেয়ে গভীরভাবে নজর দেওয়া হয়। এক. শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার মান ও পদ্ধতি; দুই. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান পদ্ধতি। এ দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে তারা শিশুদের গড়ে তোলার নীতিমালা তৈরি করে, যেখানে জোর দেওয়া হয় শিশুদের সৃজনশীলতা, খেলাধুলা, সমন্বিত শিখন পদ্ধতি, শিশুদের কর্মকাণ্ড ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ওপর।

চীনে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সুদীর্ঘ ইতিহাস, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮৮৯ সালে নার্সারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। শিশুদের যত্ন ও খ্রিষ্টীয়ান প্রথা-বিশ্বাসকে যেখানে কারিকুলামে রাখা হতো। কিন্তু ১৮৯৫ সালের পর সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল শিক্ষাব্যবস্থাকে বিদেশি কারিকুলামের আদলে ঢেলে সাজানোর। জাপান যেহেতু চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, সে ক্ষেত্রে চীন জাপানকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আদলে তৈরি করল চীনের প্রাথমিক শিক্ষানীতি। চীন ও জাপানের ভাষাগত মিল থাকায় খুব সহজেই চীন প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদানে জাপান থেকে প্রশিক্ষকদের নিয়ে আসা শুরু করে।

১৯৪৯ সালের পর থেকে শিক্ষার সব বিষয়ে রাশিয়াকে রোল মডেল হিসেবে ধরে নিয়ে তাদেরকে অনুকরণ করতে শুরু করে চীন। ফলে রাশিয়া থেকে শত শত প্রশিক্ষক আনা শুরু হয় চীনের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে অনেক উচ্চতর প্রশিক্ষণের পথ সুগম হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কিন্ডারগার্টেনকে কার্যকরী শিক্ষাঙ্গন হিসেবে গড়ে তোলাকে প্রধান সুপারিশ হিসেবে ঘোষণা করে 'টিচার্স স্কুল রেগুলেশন' প্রণীত হয়, যেখানে শিশুদের রাজনীতি, ভাষা, শিল্প-সাহিত্য, গণিত, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যজ্ঞান প্রদানের বিষয় মুখ্য থাকবে। চীনের প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ বা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যদি সার্বিকভাবে বলি তাহলে দেখা, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো পর্যাপ্ত বড় পরিসরের এবং অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষের পাশে আরেকটি কক্ষ রয়েছে, সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা বা কিছু সময় বিশ্রাম নিতে পারে। যোগাযোগ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, যেখানে সহজেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার মিথস্ট্ক্রিয়াটা গড়ে ওঠে খুবই ফলপ্রভূভাবে।

প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় কোমলমতি শিশুদের কীভাবে শেখালে, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে তারা সহজভাবে শিখতে পারবে, এসব সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) মাধ্যমে একজন শিক্ষক ধারণা নিতে পারেন কীভাবে পাঠদান পদ্ধতি আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, শিশুদের ভেতরের সম্ভাবনাকে জাগ্রত করা যায়, তার ভেতরে শিশুমনে কীভাবে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন মানুষের বীজ বপন করা যায়। আগে মূলত এটি যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা আগ্রহী ছিলেন, তারা এক বছরের এই প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়ে সফল হলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেন, যা 'প্রি-সার্ভিস ট্রেনিং' হিসেবে পরিচিত ছিল। চাকরিতে যোগদানের পর এক বছর ট্রেনিং কোর্সে অংশ নিতে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তাদেরকে যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো- চাইল্ড সাইকোলজি লার্নিং, ইভালুয়েশন অব পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড টিচিং মেথড।

চীন, জাপান ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে যতটুকু দেখেছি, আমার মনে হয়েছে, একটি শিশুর সম্ভাবনা, তার বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা, মানসিক বিকাশ সাধন, নৈতিকতা এ সবকিছুর সমন্বয়ে সে গড়ে উঠতে পারে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে। আর সে কাজটি বাস্তবে রূপদান করতে পারে একজন মা ও একজন শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আসল কারিগর। আর সেসব কারিগরের ছোঁয়ায় গড়ে উঠুক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

 লেখক: মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম

প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে - dainik shiksha তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত - dainik shiksha বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003140926361084