ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল - দৈনিকশিক্ষা

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল

মো. বাশির উদ্দিন |

দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরব বিস্ময়কর। ১৮৩৫ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টি ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। এটি ছিল বাংলার প্রথম সরকারি স্কুল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ঢাকা কলেজ, ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার এই ধারাবাহিকতার সূচনায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মহান ব্রত নিয়ে স্কুলটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্কুলটিকে তার মূল ভবন থেকে সরিয়ে সেই ভবনটিকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান করা হয়। ফলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সম্প্রতি সদরঘাটে গিয়ে স্কুলটি চোখে পড়তেই নতুন করে মনে পড়ল এর ইতিহাস। আলাপ হলো একজন বিদ্যানুরাগী, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. হারুন অর রশীদের সঙ্গে। বিদ্যালয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করার কথা জানালে তিনি উৎসাহিত হয়ে অনেক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করলেন আমাকে। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ২০১০ সালে স্কুলটির ১৭৫তম বর্ষপূর্তি উদ্্যাপিত হয়েছে।

এ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘স্মৃতিময়’ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে তথ্যসমৃদ্ধ একটি ম্যাগাজিনও দিলেন। শিক্ষাবিস্তারে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের অবদান অতুলনীয়। বাংলা বিহার উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে গঠিত প্রেসিডেন্সি বেঙ্গলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯ বারের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৮ বার প্রথম হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। পাকিস্তান আমলে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র। ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। দেশবরেণ্য এসব স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি, উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু, শহিদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বাঙালি উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন, সব্যসাচী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত, বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তওফিক ইমাম, সভাপতি, ঢাকা কলেজিয়েট অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, জনাব রাশেদ খান মেনন এমপি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বদিউর রহমান, সাবেক সচিব, ড. সালেহ্‌ উদ্দীন আহমেদ, সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক, অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ড. চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম, সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. ইকবাল মাহমুদ, সাবেক উপাচার্য, বুয়েট, ড. সরওয়ার আলী, ট্রাস্টি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, খন্দকার মুনীরুজ্জামান বিএসসি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ, আবদুল কাইয়ুম, যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো প্রমুখ।

এই হলো ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের গৌরবময় ইতিহাসের অংশবিশেষ। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে স্কুলটি তার শতাধিক বছরের ঐতিহ্য ও গৌরব হারায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিলে তাদের নিজস্ব ভবনে চলে যাওয়ার পরও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ভবন ও জায়গা বিদ্যালয়কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি, যা ছিল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের নিজস্ব সম্পত্তি। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জায়গা ও ভবনটি জগন্নাথ কলেজকে অন্যায়ভাবে দিয়ে দেন। এ ঘটনায় স্কুলের সকল প্রাক্তন ছাত্র মর্মাহত হন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক কবি সৈয়দ শামসুল হক লন্ডনে চিকিৎসায় গিয়েও কথাসাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে এই বেদনা প্রকাশ করেছেন।

উপমহাদেশের প্রথম বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এ অঞ্চলের পশ্চাৎপদ জনগণকে পাশ্চাত্য ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার চারশ বছরের ইতিহাসে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও আধুনিক মননশীলতার বিকাশে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের অবদান অতুলনীয়। অথচ অতীতে স্কুলটি যেভাবে বঞ্চিত হয়েছে, আজও তার অবসান ঘটেনি। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিদ্যালয়টির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে এবং তাদের অবহেলা, অনাদর ও উপেক্ষায় স্কুলটির অতীত সুনাম ক্ষুণ্ন হতে বসেছে। জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া জায়গা ও স্থাপনাসমূহ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলকে ফিরিয়ে দেয়া হলে স্কুলটির হৃতগৌরব ফিরে আসবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ তার ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল-আদি ইতিহাস’ রচনায় লিখেছেন, ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। এ স্কুলটি না হলে বাংলাদেশ কেমন হতো তা ভাবতেও পারা যায় না। যে প্রতিষ্ঠানটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এদেশের মানুষকে শিক্ষিত করেছে, আলোকিত করেছে, খ্যাতি দিয়েছে এবং এই ভূখণ্ডকে আধুনিক সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছে তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং অবদানের কথা বস্তুনিষ্ঠভাবে পুনর্গঠন করা এখন কেবল সময়েরই দাবি।’

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ইতিহাস মানেই পূর্ববাংলায় আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের সফল ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে এ স্কুলের ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানসহ স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রেখেছেন। যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিস্ময়করভাবে সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ করে, তার আজকের করুণ পরিণতি মেনে নেওয়া যায় না। উন্নত দেশ ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করেই ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও শিক্ষাবান্ধব সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নত আধুনিক সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। অতীতের গৌরবময় ইতিহাস ও বর্তমান পরিণতির কথা বিবেচনা করে, ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের আগের জায়গা ও স্থাপনাসমূহ ফিরিয়ে দিয়ে শিক্ষাবিস্তারে অতীতের মতো স্কুলটির অবদান রাখার জন্যে শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035519599914551