ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রোকেয়া হলে কর্মচারী নিয়োগে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা, হল ছাত্রলীগ ও হল সংসদের নেতারা দুর্নীতি করছেন। এমন অভিযোগ উঠেছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এরপর জিনাত হুদার পদত্যাগসহ স্বচ্ছ নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদিকে, হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার অপরাধে দুই শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে হল প্রশাসন সাত দিনের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে।
তবে, এটাই শেষ নয়। সেই দুই শিক্ষার্থীর কাছে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তার অনুলিপি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ চার নেতার কাছে পাঠিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের স্ত্রী ও হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবে হল প্রশাসন, ছাত্রলীগ নয়।
জানা যায়, গত বছরের ২৫ জুলাই রোকেয়া হলে চারটি পদে কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেন হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা। সেখানে অফিস সহায়ক পদে একজন, বাগানের মালি পদে একজন, নিরাপত্তা প্রহরী পদে তিনজন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে তিনজন নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানানো হয়।
৩১ জুলাই ছিল আবেদনের শেষ দিন। ১ সেপ্টেম্বর এসব পদে আবেদনকারীদের মৌখিক পরীক্ষা হলেও কর্মচারী নিয়োগে হল প্রশাসন ও শাখা ছাত্রলীগ ও হল সংসদের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে হলের কয়েকজন ছাত্রী অভিযোগ করেন, রোকেয়া হলে নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কয়েকটি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে হল সংসদের ভিপি ইসরাত জাহান তন্নী, জিএস সায়মা প্রমি এবং হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী ইসলাম ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক ইশাত কাশফিয়া তিন ব্যক্তির কাছ থেকে ২১ লাখ টাকা নিয়েছেন। এর সঙ্গে হলের প্রাধ্যক্ষেরও যোগসাজশ রয়েছে। এরপর হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে ছাত্রী। অনশনে বসে কয়েকজন ছাত্রী।
অভিযোগ তদন্তে ৫ সেপ্টেম্বর তিন সদস্যের একটি কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক বেগম আকতার কামালকে আহ্বায়ক ও সহকারী প্রক্টর লিটন কুমার সাহাকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটির আরেক সদস্য রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষক মনিরা বেগম।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট রাতে এসব তথ্য একটি ফেসবুক গ্রুপে প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী শ্রবণা শফিক দ্বীপ্তি। এজন্য তাকে চিঠি দিয়ে হল কার্যালয়ে তলব করেন প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা। পরে কার্যালয়ে গেলে প্রাধ্যক্ষের সামনে ছাত্রলীগ নেত্রীদের লাঞ্ছনার শিকার হন বলে অভিযোগ করেন দ্বীপ্তি।
তবে, নানা নাটকিয়তার পরে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়ে জানিয়েছে, দুর্নীতির বিষয়ে আনীত অভিযোগ মিথ্যা। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গত ১৫ জানুয়ারি দুর্নীতির অভিযোগ তোলার অপরাধে হলের দুই শিক্ষার্থী কারুশিল্প চারুকলা বিভাগের ফাল্গুনী দাস তন্বী ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী শ্রবণা শফিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে হল প্রশাসন এবং সাত দিনের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়।
কিন্তু ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ফাল্গুনী দাস তন্বীর কাছে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তার অনুলিপি দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, ঢাবি শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনকে। বিষয়টি জানাজানি হলে সমালোচনার ঝড় তোলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠির অনুলিপি যাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে, রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে নয়।
জানতে চাইলে ফাল্গুনী দাস তন্বী বলেন, প্রথমত অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাছাড়া, তিনি ভুল করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর বিচার করবে। চিঠি যাবে তার অভিভাবক, বিভাগ, প্রক্টর, ভিসির কাছে। কিন্তু আমার নেতাদের কেন দেয়া হলো, সেটা তিনি জানেন না। এটাকে তিনি কোনভাবেই সমর্থন করতে পারেন না।
তিনি বলেন, তিনি িরোকেয়া হলে ছাত্রলীগের পদপ্রার্থী। এজন্য কেউ হয়তো হল প্রশাসনকে ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি অবহিত করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এটা হতে পারেনা। সংগঠনকে চিঠি দেয়ার কোন নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে তার কাছে চিঠি যাবে। শিক্ষার্থীকে শিক্ষার্থী হিসেবে দেখতে হবে।
তবে, অভিযুক্ত হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গত বছর যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন সাংবাদিকদের ফোন এড়িয়ে চলেন অভিযুক্ত জিনাত হুদা।