নিরাপদ টয়লেট বঞ্চিত ৬৭ ভাগ স্কুলছাত্রী - দৈনিকশিক্ষা

নিরাপদ টয়লেট বঞ্চিত ৬৭ ভাগ স্কুলছাত্রী

রাশেদ রাব্বি |

তৃষ্ণা যতটা সময় সহ্য করা যায় ততটা সময় পানি পান না করেই থাকে রাজধানীর একটি সরকারি বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ইভা আক্তার। প্রতিদিন স্কুলে আসার সময় পানি অপেক্ষাকৃত কম পান করে সে। কারণ তার স্কুলে মেয়েদের জন্য টয়লেটটি ভালো না। সেখানে যেতে হলে লাইন ধরতে হয়।

ইভা জানায়, স্কুলে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। তারপরও তাদের জন্য ফিমেল কর্নার নেই। ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত চারটি ক্লাসে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য মেয়েকে ঋতুকালীন সমস্যার কারণে অনুপস্থিত থাকতে হয়। একটি ফিমেল কর্নারের ব্যবস্থা থাকলে এসব ছাত্রীর মাসে তিন থেকে চার দিন অনুপস্থিত থাকতে হতো না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সমস্যা শুধু একটি স্কুলে নয়। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট নেই। থাকলেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেক স্কুলে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এক গ্লাসে সবাইকে পানি পান করতে হয়। যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৩-এর লক্ষ্য ছিল ২০১৭-র জুনের মধ্যে দেশের ৯৫ শতাংশ সরকারি স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ স্কুলে ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৬৭ শতাংশেই ছাত্রীদের পৃথক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে অধিদফতরের ‘অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের ‘প্রাইমারি স্কুল কোয়ালিটি লেভেল’-এ আরও বলা হয়, সরকারি ১৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শৌচাগারও নেই। একটি টয়লেট বিদ্যমান থাকা স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েরা যৌথভাবে তা ব্যবহার করে থাকে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি একটি টয়লেট থাকে তবে তা ব্যবহারে মেয়েদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কমন টয়লেটের পাশে ছাত্রীদের আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এদিকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন সার্ভের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য টয়লেট রয়েছে একটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪৫ শতাংশ টয়লেট বন্ধ থাকে। চালু থাকা টয়লেটের দুই-তৃতীয়াংশের ভেতরে বা কাছাকাছি পানি ও হাত ধোয়ার সাবানের ব্যবস্থা থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। ঋতুস্রাবকালীন অনেক মেয়েকে স্কুলে অনুপস্থিত দেখা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরদারিতে আনতে হবে। ওই কমিটি এ খাতের জন্য পৃথক একটি সংরক্ষিত তহবিলের ব্যবস্থা করবে। টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ করবে। সংরক্ষিত তহবিল থেকে এ ব্যয় মেটান যাবে। পরিপত্রে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, টয়লেটে ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, ঋতুকালীন (মাসিক) বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেয়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে) রাখার কথাও ছিল। নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপেয় পানি, টয়লেট ব্যবস্থা, মেয়েদের পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা আছে কিনা, সে বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকতে হয়।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা বলেন, সরকারি স্কুলে যে কোনো কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। থানা ও জেলা কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। স্থানীয়দের নিয়ে একটি কমিটি রয়েছে তারা সব কাজে নাক গলায়। তিনি বলেন, স্কুলের চাহিদা থাকে পর্যাপ্ত। শিক্ষকদের সামান্য বেতনের টাকায় এসব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ জন্য বরাদ্দও থাকে না। সরকারিভাবে বরাদ্দ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ স্যানিটেশনের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে মুগদা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আরিফা শারমিন মায়া (ডেপুটেশনের বিএসএমএমইউতে কর্মরত) বলেন, স্কুলের টয়লেট বা মানসম্পন্ন স্যানিটেশন না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে মেয়েরা পানি না খেয়ে থাকে। এতে করে তারা ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ফলে জ্বর, পেট ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা তাদের লেগেই থাকে। অনেকের শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দেয়। তিনি বলেন, মেয়েদের একটি প্রাকৃতিক সমস্যা হল ঋতুকালীন সমস্যা। অনেকের জীবনের প্রথম মাসিক হয় স্কুলে। কিন্তু স্কুলগুলোতে এ সময় প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার ব্যবস্থা না থাকায় তারা বিপাকে পড়ে। আবার অনেকেরই প্রায়ই স্কুলে ঋতুস্রাব হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় এসব ছাত্রী লোকাল ইনফেকশনে ভোগে। তিনি বলেন, এ সমস্যাটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনে লাইব্রেরির মতো ফিমেল কর্নারও বাধ্যতামূলকভাবে রাখা উচিত। যেখানে থাকবে তাদের মাসিকের প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং প্রয়োজনের সময় তারা সেখানে গিয়ে নিরাপদে কাপড় বদল করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যথেষ্ট গোপনীয়তা এবং মেয়েদের জন্য আলাদা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপযোগী টয়লেট- এ বিষয়গুলো শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিত করে। তাই দেশের প্রত্যেক স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিসহ সবার অংশগ্রহণে প্রতিটি পর্যায়ে এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে স্কুলগুলোতে উন্নত স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকার গুরুত্ব অনুধাবনে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যথেষ্ট সহযোগী মনোভাব পোষণ করা এবং তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারেও বিষয়টির যথাযথ প্রতিফলন হওয়া দরকার।

 

সৌজন্যে: যুগান্তর

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066831111907959