স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এখনকার মতো এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ইংরেজি মাধ্যমে এ সংকট ছিল আরও তীব্র।
তখন আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখার জন্য বিদেশে পাঠালেও সেসব শিক্ষার্থী আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেত না। শুক্রবার (২৯ মে) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ওই সময় কেবল সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই নিলুফার মঞ্জুর সানবিমস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে নিলুফার মঞ্জুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে।
এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শৈশবে যে শিক্ষা পেয়ে থাকে, তা আজীবন তাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
আমার তিন সন্তান এই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করার কারণে নিলুফার মঞ্জুর ও তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। তিনি আমাদের সংস্কৃতি শিশুদের জানাতে কতটা তৎপর ছিলেন, তা-ও আমার দেখার সুযোগ হয়েছে।
পড়ালেখার পাশাপাশি শরীরচর্চাকে তিনি এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাভারের বিকেএসপিতে নিয়মিত পাঠানো হয়। শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ পরবর্তী সময়ও অব্যাহত থাকার ফলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে সফল হওয়ার সুযোগ বিস্তৃত হয়।
ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলে একজন শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষালাভের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ব্যাপক সুযোগ পাচ্ছে এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শরীরচর্চার বিষয়ে যথাযথ উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে- সানবিমসের মতো রাজধানীর আর কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনটি লক্ষ করা যায়?
অধ্যক্ষের পাশাপাশি একদল নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের প্রচেষ্টার কারণে সানবিমসের সুনাম উত্তরোত্তর বাড়ছে। যে মনোভাব নিয়ে ১৯৭৪ সালে নিলুফার মঞ্জুর সানবিমস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বিবেচনা করে সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে এগিয়ে এলে যত বাধাই আসুক সব অতিক্রম করে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা সহজ হবে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা একবার ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। ওই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আহত হই আমি।
ওই গাড়িতে আমার মেয়েও ছিল, যে সানবিমসে পড়াশোনা করত। দুর্ঘটনার পরদিন আমি পুরোপুরি বিছানায়। তখন মনে হচ্ছিল বেশ কয়েক দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।
কিন্তু ততদিন তো আর মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখা যায় না। দুর্ঘটনার পরদিনই আমি আমার মেয়েকে তার বাবার সঙ্গে স্কুলে পাঠিয়ে দিই।
যেহেতু আমার মেয়ে সব সময় আমার সঙ্গেই স্কুলে যেত, সেজন্য সে সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারল কিনা, এ ব্যাপারে আমার চিন্তা হচ্ছিল। একসময় টেলিফোনে স্কুলের প্রিন্সিপাল নিলুফার মঞ্জুরকে বিষয়টি জানাই এবং তাকে অনুরোধ করি তিনি যেন আমার মেয়েকে বিশেষভাবে খেয়ালে রাখেন।
আমি অবাক হলাম স্কুলে এত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও তিনি এবং আমার মেয়ের শ্রেণিশিক্ষক স্কুলের গেটেই আমার মেয়েকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন, যা পরে আমি টেলিফোন করে জানতে পারি।
অবাক হওয়ার বিষয় হল, আমার মেয়ে পরপর কয়েক দিন ট্রমা থেকে মুক্ত হতে না পারলেও তার শ্রেণিশিক্ষক তাকে বিশেষ যত্নের সঙ্গেই সময় দেন।
এই একটি ঘটনাই নয়, আমি জেনেছি নিলুফার মঞ্জুর এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি দায়িত্বের ব্যাপারেই সব সময় বিশেষভাবে সতর্ক ও সচেতন থাকতেন।
তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নিতেন, সবাইকে চিনতেন এবং কে কতটা মনোযোগী, সব সময় তা মনিটর করতেন।
যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য কেবল প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ওপরই নির্ভর করে না, অন্য কর্মীদের ওপরও নির্ভর করে, বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারই সবসময় একটি টিমওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
এই চেষ্টায় অনেকেই সফল হতে পারেন না। কিন্তু নিলুফার মঞ্জুর এই চেষ্টায় প্রকৃত অর্থেই সফল হয়েছেন। আমরা জেনেছি, এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকসহ অন্যরা সাধারণভাবে একবার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেন না।
যেহেতু শিক্ষকরা দীর্ঘসময় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই এর সবচেয়ে বেশি সুফল পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই ওই স্কুলের শিক্ষকদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যার ফলে আমার জানামতে, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিজীবনে বিশেষভাবে সফল হতে পেরেছে।
একবার আমি নিলুফার মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আগে থেকেই তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। কাজেই যথাসময়ে তার দেখা পাব, এটাই ছিল আমার প্রত্যাশা।
কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই তার সঙ্গে আমার দেখা হল। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন তার দেরি হওয়ার কারণে। পরে কেন দেরি হল তা তিনি জানালেন- ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানের মহড়া দিচ্ছিল শিক্ষার্থীরা, সেই মহড়ার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের পাশে উপস্থিত ছিলেন।
পরে জেনেছি, এরকম প্রায় সব বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিতেন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা যাতে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো শিক্ষার্থীর যেন কোনো ঘাটতি না থাকে তার জন্য নিলুফার মঞ্জুরের কঠোর মনিটরিং ছিল। ফলে সানবিমসের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতির ব্যাপারেও জানার সুযোগ হয়ছে।
এখন তো বাংলা মাধ্যমে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও মাঝেমধ্যে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, তার সন্তান বা পরিবারের সদস্য (নতুন প্রজন্ম) দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কতটা জানতে পারছে, এ বিষয়ে তারা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে যখন আমরা সানবিমসের শিক্ষা পরিবেশের তুলনা করি, তখন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থেই সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়।
আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নতুন প্রজন্মকে বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জন করতে হবে।
পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও প্রকৃত তথ্য জানার বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহী হতে হবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের কোনো শাখাতেই অপূর্ণ থাকলে চলবে না।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং প্রতিযোগিতায় সামনের সারিতে থাকতে হলে দেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আমার মনে হয় সানবিমস সেই মানের শিক্ষার্থী গড়ে তোলার বিষয়ে পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
নিলুফার মঞ্জুরের নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠান যে সুনাম অর্জন করেছে তা যেন অব্যাহত থাকে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক থাকবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তার কাজের মধ্য দিয়ে নিলুফার মঞ্জুর আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
লেখক : রাশেদা কে চৌধুরী,গবেষক, শিক্ষা বিষয়ক এনজিওর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী।