পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি আমরা করেছি। সেই চুক্তি বাস্তবায়নের কাজও করে যাচ্ছি। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় যে অক্ষর আছে, আমরা সেই অক্ষরে তাদের নিজস্ব ভাষায় বই ছাপিয়ে দিয়েছি। পাহাড়ে শিক্ষাকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি।
রোববার (২১শে জানুয়ারি) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) অধীন শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘পাড়া কেন্দ্রের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে আমি বলব, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কারণ, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
সরকার শান্তিচুক্তির সিংহভাগ বাস্তবায়ন করেছে উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘জমি-জমার মালিকানা সেই ব্রিটিশ আমলে করা আইন দিয়ে নয় বরং আমাদের সব জায়গার মানুষ যেন তাদের ভূমির মালিকানাটা পায়, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যেন তাদের ভূমির মালিকানাটা সেইভাবে নিতে পারে-সেটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে আমি বলব, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কারণ, শান্তিপূর্ণ পবিবেশ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেটা মাথায় রেখেই আমি সকলকে একযোগে কাজ করার আহবান জানাচ্ছি। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।’শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের একটা অঞ্চল অবহেলিত থাকবে এটা সরকার চায় না। পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে তাঁর সরকার এবং এজন্য এটার বাস্তবায়নও সরকার করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আড়াইশ’র মত সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছি এবং সেখানকার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) বিওপি তৈরী করে দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সরকার প্রধান বলেন, যারা অস্ত্র সমর্পন করেছিল তাদের পুলিশ এবং আনসার-ভিডিপিতে চাকরি দেয়া হচ্ছে। তাদের জন্য প্রয়োজনে নীতিমালা পর্যন্ত শিথিল করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা সিদ্ধ চাল খেতে পারে না, তাই আতপ চালের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল তাদের প্রশিক্ষণের সময়। এভাবে তাদের জন্য প্রতেকটি উদ্যোগ অত্যন্ত যতœসহকারে করছে তাঁর সরকার, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এখান আধুনিক পদ্ধতিতে জমি-জমা চাষ হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর জমি-জমার মালিকানা সেই ব্রিটিশ আমলে করা আইন দিয়ে নয় বরং সব জায়গার মানুষ যেন তাদের ভূমির মালিকানাটা পায়, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যেন তাদের ভূমির মালিকানাটা সেইভাবে নিতে পারে-আমরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাই। কাজেই ঐ মালিকানা তাদেরই (পার্বত্যবাসীর) থাকবে সেটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রী পরে ‘চিটাগাং হিলট্রাক্টস জার্নি টুওয়ার্ডস পিস এন্ড প্রসপারিটি’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং ইউনিসেফে’র সহযোগিতায় রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার মিটিঙ্গাছড়িতে পাকা দালান বিশিষ্ট এই ৪০০০তম পাড়াকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উসেসিং-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আরএএম ওবায়দুল মুক্তাদীর চৌধুরী এবং ইউনিসেফের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এডুয়ার্ড বেইগবেডার বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা প্রদান করেন এবং ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনিতিকবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাড়াকেন্দ্রেগুলোর ৪শ’ জন সদস্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাড়াকেন্দ্র নিয়ে একটি ভিডিও তথ্যচিত্রও পরিবেশিত হয়।
ইন্টিগ্রেটেট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আইসিডিপি) জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফে’র সহযোগিতায় ১৯৮০ সাল থেকে পার্বত্য তিন জেলা- রঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবনে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। তখন থেকেই ইউনিসেফে’র সহযোগিতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মা, শিশু ও কিশোরীদের উন্নয়নে চলছে বিশেষ কার্যক্রম। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই প্রকল্পেরই এক অন্যন্য আবিস্কার পাড়া সেন্টার বা পাড়াকেন্দ্র। সরকারের বিভিন্ন রকম সেবা বিভিন্ন পাড়ার জনগণের দোরগোঁড়ায় পৌছে দেয়াই এই কেন্দ্রের কাজ। যার মধ্যে রয়েছে- শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, প্রাক স্কুল শিক্ষা, পুষ্টি বিষযক শিক্ষা, ভিটামিন ‘এ’ ও আয়রন বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবার আওতায় মা ও শিশুর টিকা নিশ্চিতকরণ, জন্ম নিবন্ধন, শিশু বিবাহ রোধ, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত উঠোন বৈঠক পরিচালনা করা ইত্যাদি। এছাড়া, প্রতিটি পাড়া সেন্টারে কিশোর-কিশোরির বিকাশের সুব্যবস্থাও রয়েছে। ১৯৮০ সালে ১১টি মৌজায় ৩ হাজার পরিবার নিয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি বর্তমানে ৩ হাজার ৫১৯টি পাড়ায় সেবা প্রদান করছে।