প্রতিশোধ পরায়ণ শিক্ষক ও দুদকের জিভ কাটার গল্প - দৈনিকশিক্ষা

প্রতিশোধ পরায়ণ শিক্ষক ও দুদকের জিভ কাটার গল্প

চৌধুরী মুমতাজ আহমদ |

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে বিব্রত হতে হয়েছে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ফোন গেছে প্রধান শিক্ষকের কাছে। আর এসব খণ্ড খণ্ড ঘটনার পেছনে রয়েছে আরো একটি বড় ঘটনা। এসব ঘটনার শোধ দিতে হলো এসএসসি পরীক্ষার্থী জিসান দেবনাথ নীল মাধবকে। শিক্ষকের নিষ্ঠুরতায় অথবা প্রতিশোধ পরায়ণতায় এ বছর আর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার। হঠাৎ আসা ঝড়ে একদমই ভেঙে পড়েছে জিসান। খাওয়া-দাওয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে সে। 

সিলেট নগরীর পাঠানটুলা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্ট থানাধীন ডলিয়া এলাকার বাসিন্দা জিসানের। সব ঠিক থাকলে এখন তার ব্যস্ত থাকার কথা ছিলো পরীক্ষা নিয়ে। তবে তাকে সব ব্যস্ততা থেকে আপাতত ‘মুক্তি’ দিয়েছে তার বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের ‘গাফিলতি’র কারণে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে জিসান। তবে জিসানের মায়ের দাবি ইচ্ছে করেই তার ছেলেকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। কারণ তিনি পরীক্ষার ফি নিয়ে বিদ্যালয়ের অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বিষয়সহ ফরম পূরণের ক্ষেত্রে বোর্ড ফি ১ হাজার ৩৮৫ টাকাসহ ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়ার কথা।

কিন্তু পাঠানটুলা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ফি নেওয়া হচ্ছিলো ৩ হাজার ২০৫ টাকা। অতিরিক্ত ১ হাজার ৪০৫ টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে তা জানতে চান জিসান দেবনাথের মা সনাতন কল্যাণ সোসাইটির এয়ারপোর্ট থানা সভাপতি জয়ন্তীবালা দেবী। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক কেউই তাকে সদুত্তর দিতে পারেননি। সদুত্তর দিতে না পারলেও তারা জানান পরীক্ষা দিতে হলে ৩ হাজার ২০৫ টাকাই দিতে হবে। বাধ্য হয়ে ৩ হাজার ২০৫ টাকাই জমা দেন জয়ন্তীবালা। টাকা নিলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো রসিদও দেননি। বিষয়টিতে খটকা লাগে জয়ন্তীবালা দেবীর। তিনি বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে। দুদক থেকে এ নিয়ে স্কুলে খোঁজখবর নেওয়া হয়। ফোন যায় প্রধান শিক্ষক আবদুল হান্নানের কাছে। এরই মাঝে এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেয়া শুরু হয়।

পরীক্ষার সময় কাছে এলেও জিসান তার প্রবেশপত্র পাচ্ছিলো না। স্কুলে খোঁজ নিলে জানানো হয় প্রবেশপত্র আসেনি। স্কুল থেকে বলা হয় কেন্দ্রে খোঁজ নিতে। ৩১ জানুয়ারি জয়ন্তীবালা ছুটে যান পরীক্ষাকেন্দ্র আম্বরখানা গার্লস হাই স্কুলে। জানতে পারেন সেখানেও আসেনি প্রবেশপত্র। আম্বরখানা গার্লস হাই স্কুল থেকে ফোন দেওয়া হয় পাঠানটুলা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হান্নানকে। তিনি ফোনে জানান, জিসানের ফরম পূরণই হয়নি, প্রবেশপত্র আসবে কোত্থেকে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে জয়ন্তীবালার। কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। ফরমের টাকা জমা দিয়েছেন, ফরমও পূরণ করা হয়েছে, তারপরও কেন এমনটি হলো? জয়ন্তীবালা ছুটে যান সিলেট শিক্ষাবোর্ডে। সাক্ষাৎ করেন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল কুদ্দুসের সাথে। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে আসতে পরামর্শ দেন।

হাতে একদমই সময় নেই। বোর্ডে থেকেই জয়ন্তীবালা ফোন করেন প্রধান শিক্ষক আবদুল হান্নানকে। অনুরোধ করেন বোর্ডে আসার জন্য। প্রধান শিক্ষক সাফ জানিয়ে দেন, পারবেন না তিনি। জানান, ২৭ জানুয়ারি বোর্ডে তাকে অপমান করা হয়েছে। তিনি কিছুতেই বোর্ডে যাবেন না। তখন জয়ন্তীবালা তাকে অন্তত একটা দরখাস্তে স্বাক্ষর দিতে বলেন। তিনি সেটাও অস্বীকার করেন। কোনো উপায় না পেয়ে বোর্ডেই এর-ওর কাছে ছোটাছুটি করেন জয়ন্তীবালা। তার ছোটাছুটিতে বিরক্ত হয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান তিরস্কার করে বের করে দেন জয়ন্তীবালাকে। বলে দেন স্কুলের কোনো শিক্ষক ছাড়া এলে লাভ হবে না।

জয়ন্তীবালা ফোন দেন জিসানের শ্রেণিশিক্ষক ননী গোপালকে। এর আগে তিনি জয়ন্তীবালাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলেন। জয়ন্তীবালার মনে তাই আশা ছিলো ননী গোপাল হয়তো তাকে সহায়তা করবেন। কিন্তু ননী গোপাল আরো ভয় ধরিয়ে দেন জয়ন্তীবালার মনে। ননী গোপাল জানান, জিসান পরীক্ষাই দেয়নি, ফরমের ফিও জমা দেয়নি। অথচ নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে ফরমের পূরণের জন্য ৩ হাজার ২০৫ টাকা জমা দিয়েছে। ননী গোপালের কাছেই টাকা জমা দেওয়া হয়। আগের এক ফোনালাপে ননী গোপাল নিজেই সেটি স্বীকারও করেছেন। যার রেকর্ড রয়েছে জয়ন্তীবালার কাছে। সকল ফোনালাপের রেকর্ডই তিনি জমা দিয়েছেন দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদকের কাছেও।
 
কোনো উপায়ই খুঁজে পান না জয়ন্তীবালা দেবী। জানতে পারেন পরদিন সিলেট আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। অন্ধকারে যেন এক চিলতে আশার আলো দেখতে পান জয়ন্তীবালা। তিনি পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি ছুটে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বাসভবনে। গিয়ে দেখেন সেখানে উপস্থিত বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল কুদ্দুসও। তার সামনেই ছেলের পরীক্ষার বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন জয়ন্তীবালা। বোর্ড চেয়ারম্যানকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিছুটা বিব্রতবোধ করেন বোর্ড চেয়ারম্যান। মন্ত্রীকে তিনি জানান, জয়ন্তীবালার ছেলে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাসই করেনি। জয়ন্তীবালা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুসের এ জবাবের চ্যালেঞ্জ করেন। মন্ত্রী তখন বিষয়টি দেখে দিতে বলেন। মন্ত্রীর নির্দেশে পরদিন সকালে জয়ন্তীবালাকে বোর্ডে আসতে বলেন চেয়ারম্যান। হাতে সময় নেই, পরদিনই শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা। জয়ন্তীবালা যোগাযোগের চেষ্টা করেন জিসানের শ্রেণিশিক্ষক ননী গোপালের সাথে।
 
কিন্তু তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পান। উপায়ান্তর না পেয়ে রাতে ছুটে যান ননী গোপালের বাসায়। কিন্তু না। মধ্যরাত পর্যন্ত কয়েকবার তিনি যান ননী গোপালের বাসায়। নাগাল পান না ননী গোপালের। সারারাত চেষ্টা করে ফোনেও নাগাল মিলছিলো না ননী গোপালের। সারারাত ঘুমহীন কাটে জয়ন্তীবালার। ভোরে আবার ছুটে যান ননী গোপালের বাসায়। এবার দেখা মেলে তার। অনুরোধ করেন তার সাথে বোর্ডে যাওয়ার জন্য। ননী গোপাল জানান, জয়ন্তীবালার সাথে তিনি বোর্ডে যাবেন না, একাই যাবেন। যাওয়ার সময় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে জয়ন্তীবালাকে বলেন, ‘জয়ন্তী নিজেই নিজের কপাল পুড়াচ্ছেন।’ ননী গোপাল কেন একথা বললেন সেটা তখনও বুঝতে পারেননি জয়ন্তীবালা। তবে বোর্ডে যাওয়ার পর মানেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় জয়ন্তীবালার কাছে। বোর্ডে ননী গোপাল পরীক্ষার খাতা উপস্থাপন করে প্রমাণ করেন জিসান পাস করেনি টেস্টে। বোর্ডে উপস্থাপিত খাতা দেখে চমকে যান জয়ন্তীবালা। খাতার হাতের লেখাগুলো তার ছেলের নয়। কিন্তু তার আর কিছুই করার থাকে না। বোর্ডের চেয়ারম্যান আগেই বলেছিলেন-তারা ব্যক্তিকে চেনেন না, চেনেন শুধু প্রতিষ্ঠানকে, তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানই বড় কথা। ঘড়ির কাঁটা এগুতে থাকে, পরীক্ষার সময় হয়ে আসে। সহপাঠীরা সবাই পরীক্ষার হলে প্রবেশ করলেও জিসানের আর প্রবেশ করা হয়নি পরীক্ষার হলে।
জিসান দেবনাথের শ্রেণিশিক্ষক ননী গোপালে সাথে কথা হয়। দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘কিছুই জানিনা আমি।’ পরামর্শ দেন প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলার। মোবাইলে আলাপ হয় পাঠানটুলা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হান্নানের সাথে। তিনি দৈনিক শিক্ষাকে জানান, ফরম পূরণই করেনি জিসান দেবনাথ! ফেল করেছে টেস্টে। টেস্টে ফেল করাদের পরীক্ষার সুযোগ দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দুদক। মনে করিয়ে দেন তা-ও। আবদুল হান্নান জানান, এ বিষয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান তাকে তলব করেছিলেন তিনি সেখানে পরীক্ষার খাতাসহ সকল প্রমাণ জমা দিয়েছেন।
 
পাদটীকা: দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ারি দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে এবং লোভের জিহ্বা কেটে ফেলা হবে।

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045058727264404