প্রাথমিকে সহকারী প্রধান ও অফিস সহকারী - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে সহকারী প্রধান ও অফিস সহকারী

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কিছু লিখতে বসলে সবার আগে আমার নিজের প্রাইমারি স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে যায়। এ স্তরে মাত্র একজন শিক্ষকের কাছেই লেখাপড়া করেছি। অজ পাড়া গাঁয়ের স্কুল। সারা স্কুলে মাত্র পঞ্চাশ জনের মত শিক্ষার্থী। কোন মেয়ে ছিল না। স্যারের সামনের বড় টেবিলের চার পাশ ঘিরে পাঁচ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া পড়তাম। এক সময় স্যার ওয়ান-টু'র ছাত্রদের নামতা ও সংখ্যা শেখার জন্য মাঠের কোনে আম গাছের নিচে পাঠিয়ে দিতেন। সেখানে দল বেঁধে মজা করে সংখ্যা ও নামতা শিখতাম। বর্তমানের ন্যায় শিফট ছিল না। এখন সকাল শিফটে বারটা পর্যন্ত ওয়ান-টু আর বিকেল শিফটে বারটা থেকে থ্রি-ফোর-ফাইভ। প্রত্যেক স্কুলে চার-পাঁচ জনের বেশি শিক্ষক। 

আমরা পঞ্চম শ্রেণিতে কেবল বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়েছি। বিজ্ঞান, সমাজ আর ধর্মশিক্ষা বিষয় থাকলেও স্যার একা ছিলেন বলে সেগুলো তেমন পড়তে হয়নি। বই ও বিষয়ের পরিধি এত বেশি ছিল না। বছরে দু'টো মাত্র পরীক্ষা। একটি ষাম্মাসিক। অন্যটি বার্ষিক। এখন আরেকটি বেড়ে তিনটা হয়েছে।প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক ও বার্ষিক।পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী বা পিইসি পরীক্ষা। আমাদের সময় এর নামগন্ধ ও ছিল না।বড় হয়ে জেনেছি, আমাদের প্রাইমারি স্কুলের স্যার কেবল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা মানুষ। তখন পঞ্চম শ্রেণিকে 'পঞ্চম মান' বলা হতো। সেই পঞ্চম মান পড়া শিক্ষক আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এখন প্রাইমারি স্কুলে বেশির ভাগ শিক্ষক স্নাতক কিংবা অনার্স-মাস্টার্স পাশ। নানা প্রশিক্ষণ তো আছেই। কিন্তু আমার সে শিক্ষকের মাঝে যেসব গুণাগুণ ও আদর্শ দেখতে পেতাম, তা আজ খুব কম শিক্ষকের মাঝে খুঁজে পাই। 

লেখাপড়ায় বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে এখন অনেকটা সুদিন বলা চলে। স্কুলগুলোতে সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং। গাঁও-গেরামের স্কুলে ও শত শত শিক্ষার্থী। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। সুন্দর বাউন্ডারি আর গেইট। মনোরম পরিবেশ। পাঁচ-সাতজন করে শিক্ষক। বেশির ভাগ মহিলা। অনেক স্কুলে মহিলা প্রধান শিক্ষক। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার প্রসারের বিষয়টি অন্য অনেক জায়গার মত যে কোন প্রাইমারি স্কুলে গেলে সহজেই চোখে পড়ে। তাছাড়া সময় ও কালের বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষায় এখনও নানা ঘাটতি। বিদ্যালয়গুলোতে একজন করে দপ্তরি কাম প্রহরীর পদ সৃজন করে সরকার একটি কাজের কাজ করেছে। এদের নিয়োগ দেয়ার আগে রাতের বেলা অনেক স্কুলে এক শ্রেণির বাজে মানুষের আড্ডা বসত। কোথাও কোথাও স্কুলের বারান্দায় রাতে জুয়া খেলা হতো। অনেক স্কুলের আশে পাশে ও আঙিনায় ময়লা আবর্জনার স্তূপ জমে থাকত। এখন এসবের অবসান হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ, আঙিনা ও বারান্দা এখন পরিষ্কর পরিচ্ছন্ন থাকে। অনেক স্কুলে দপ্তরি নিয়োগ দেয়া বাকি। অতি সত্বর সে সব স্কুলে দপ্তরি নিয়োগ সম্পন্ন করা উচিত। দপ্তরি নিয়োগে জায়গায় জায়গায় অনিয়মের খবর পাওয়া যায়। অন্তত এসব ছোটখাট নিয়োগ যাতে বিতর্কের ঊর্ধে হতে পারে, সে ব্যবস্থাটুকু করা দরকার। তাদের চাকরিটা রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা অপরিহার্য। 

থাক এসব। যে বিষয়টি নিয়ে আজকের লেখার সূত্রপাত, সেটি হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একজন করে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অফিস সহকারীর পদ সৃজন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। গতকাল দৈনিকশিক্ষাডটকমের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত বিষয়ের লেখাটি পড়ে যে কারো এ বোধটি আরো প্রখর হবার কথা। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিগুলো এ বিষয়টি আরো আগে সামনে নিয়ে আসতে পারত। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অনেক উন্নতি হয়েছে,সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ছনের কিংবা খড়ের কাঁচা ঘরের জায়গায় পাকা দালান হয়েছে। কোথাও দু' তিনটি পাকা ভবন হয়েছে। 

এক দু'জন শিক্ষকের জায়গায় এখন আট দশজন। শিক্ষার্থী অনেক বেড়েছে। যে যাই বলি না কেন, লেখাপড়ার মান কিছুটা হলেও বেড়েছে। ঝরে পড়ার হার কমেছে। স্কুলগামিতা বেড়েছে। দেশে-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্টাফ এখন আগের চেয়ে অনেক বড়। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপবৃত্তির কাজ, পরীক্ষার কাজ, অফিসিয়াল কাজ, বিনা মূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ ও বিতরণ, শিশু জরিপের কাজ, ডিআর ফরম পূরণ ও প্রেরণ, মাসিক সমন্বয় সভায় যোগদান-ইত্যাদি আরো অনেক কাজ। কোন কোন কাজ আবার অনলাইনে করা লাগে। সব মিলে প্রাইমারিতে এখন বহু কাজ। একজন প্রধান শিক্ষকের পক্ষে এত কাজ সামাল দিয়ে একাডেমিক কার্যক্রমের তদারকি করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। এ ক্ষেত্রে একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকলে স্কুলে লেখাপড়ার বিষয়ে সমস্যা থাকে না। 

স্কুলে কোন কারণে প্রধান শিক্ষক না থাকলে পাঠদানের বিষয়টি এক রকম স্থবির হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক পালন করতে পারেন বিকল্প প্রধান শিক্ষকের ভুমিকা। আরেকটি বিষয়ের অবতারণা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে এখন থেকে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা একটু একটু করে হলেও চালু করা দরকার। আর এ জন্য সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষক নিয়োগ দেবার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।

 

সব শেষে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে একজন অফিস সহকারী নিয়োগের বিষয়ে দু' চার কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। আগেই উল্লেখ করেছি, প্রাইমারি স্কুলগুলোতে আজকাল অফিসিয়্যাল নানা কাজ। উপবৃত্তি সংক্রান্ত কাজ, পরীক্ষার চাহিদা প্রেরণ, উন্নয়নমূলক কাজ, যেমন স্লিপের কাজ ও ছোটখাট মেরামত কাজ ইত্যাদি হরহামেশা করতে হয়। সময়ে সময়ে শিক্ষক তথ্য ও শিক্ষার্থীর তথ্য হালনাগাদ করে দিতে হয়। ভাউচার ও ক্যাশবুক মেনটেইন করা লাগে। মাসে মাসে বিল করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব করতে গিয়ে প্রধান শিক্ষক সহকারীদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। তখন পাঠদান কার্যক্রম এক রকম বন্ধ করে দিয়ে সহকারীগণ প্রধান শিক্ষকের কাজে সহায়তা করেন। লেখাপড়ার মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ অবস্থায় একজন কেরানি বা অফিস সহকারী থাকলে লেখাপড়ার ব্যাঘাত হবার আশঙ্কা থাকে না। স্কুলের লেখালেখি ও অফিসের কাজকর্ম অফিস সহকারীর মাধ্যমে শেষ করা যায়। লেখাপড়ার গতি ঠিক থাকে। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ তথা মূল ভিত্তি। এটি যত মজবুত হবে, আমাদের শিক্ষা তত সুদৃঢ় হবে।                             

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068049430847168