ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বানের পানিতে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। একদিনের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৪ জেলা। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৪ জেলায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদিন সকাল ৯টা নাগাদ ১৫ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে আরও ১০ জেলা বন্যা আক্রান্ত হতে পারে। ইতিমধ্যে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে বানভাসি মানুষের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে।
অনেকের বসতঘরে পানি ঢোকায় রান্নাবান্না করতে পারছেন না। কেউ কেউ গবাদিপশু নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন। তার ওপর বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কয়েকশ’ বসতঘর ও বহু ফসলি জমি। রোববার (১৪ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
কিছু দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। বন্যায় ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ক্ষেতের ফসল। ভেসে গেছে মাছের খামার। বিভিন্ন স্কুলে পাঠদান বন্ধ হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার জেলা বন্যা আক্রান্ত ছিল। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জামালপুর, বগুড়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জে বন্যা বিস্তৃত হতে পারে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্লাবিত হতে পারে রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুরও।
বন্যা ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের এই বন্যা অন্তত দু’সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। এজন্য তারা একে ‘মধ্যমেয়াদি বন্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। সাধারণত ৫ দিনের কম স্থায়ী বন্যাকে স্বল্প আর এর বেশি স্থায়ী হলে মধ্যমেয়াদি বন্যা বলে। তিন সপ্তাহের বেশিদিন ধরে চললে তাকে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা বলে। তবে এবার এখন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে উল্লেখ করেন বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি অববাহিকায় একসঙ্গে বন্যা হলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি রূপ লাভ করে। এগুলো হচ্ছে- গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা অববাহিকা। বর্তমানে শেষের দুই অববাহিকায় বন্যা চলছে। এই বন্যা ২০১৭ সালের মতো ২৫ জেলায় বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে দেশ একটি মধ্যমেয়াদি বন্যার কবলে পড়বে।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি)। সংস্থাটির উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শনিবার বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়, সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে কয়েকদিন ধরে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে।
ওই পানি বাংলাদেশে নেমে আসছে। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরেও প্রায় সারা দেশে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে সিলেট ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টির প্রবণতা বেশি। একই অবস্থা চট্টগ্রাম বিভাগেও। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা চলছে।
আবহাওয়া ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কেবল সিলেটের লালাখানেই বৃষ্টি হয়েছে ২২৫ মিলিমিটার, কানাইঘাটে ১৫৬ মিলিমিটার ও ঢাকায় ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এভাবে প্রায় সারা দেশে বৃষ্টির প্রবণতা বেশি ছিল। অন্যদিকে ভারতের জলপাইগুড়িতে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয় ১৫৫ মিলিমিটার, এভাবে চেরাপুঞ্জিতে ১৫০, দার্জিলিংয়ে ৬৩ এবং আগরতলায় ৪১ মিলিলিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির এই পানির গতিপ্রবাহ বাংলাদেশের দিকেই। এ কারণে চীনেও ভয়াবহ বন্যা চলছে। নেপাল এবং ভারতের বিহারেও চলছে বন্যা।
এদিকে দেশের ভেতরে এবং উজান থেকে বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসায় বাংলাদেশের নদ-নদীতে এমনভাবে পানি নেমে আসছে যে তা অতীত রেকর্ড পর্যন্ত ভঙ্গ করছে। ইতিমধ্যে নীলফামারীতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে শনিবার সকাল ৯টায় পানির স্তর ছিল ৫৩ দশমিক ৩ মিটার। সন্ধ্যা নাগাদ তা আরও বেড়েছে।
এফএফডব্লিউসি জানায়, অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে দেশের ১৫ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর পানি আবার ২৩ স্টেশনে বিপদসীমার ওপরে আছে। নদীগুলো হচ্ছে- সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে। সবাইকে কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংস্থাটির অধীন স্থাপনা ও নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হলে সদর দফতরকে জানাতে বলা হয়েছে।
এদিকে বন্যা সামনে রেখে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি একাধিক টিম প্রস্তুত করেছে। এসব টিম বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি ত্রাণ এবং চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সংস্থাটি বন্যা সংক্রান্ত তথ্য আহ্বান করেছে। এজন্য ৯৩৫৫৯৯৫, ৯৩৩০১৮৮,, ৯৩৩০১৮৯, ৯৩৫০৩৯৯-২২৮ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
বান্দরবান : শুক্রবার বন্যার পানি কিছুটা কমলেও শনিবার সকাল থেকে ফের বেড়েছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। এতে আরও নতুন নতুন এলাকার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পাঁচ দিন ধরে জেলার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আন্তঃজেলার বিভিন্ন সড়কও ডুবে গেছে। জেলার ৭ উপজেলায় পানিবন্দি হয়েছেন অর্ধলাখের বেশি মানুষ। চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন তারা। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩১টি করা হয়েছে। কিন্তু প্লাবিত এলাকাগুলোর তুলনায় তা অনেক কম। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছে শত শত পরিবার। তবে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক মো. দাউদুল ইসলাম বলেন, ত্রাণ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে প্রশাসনের। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে গুদামে। আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
খাগড়াছড়ি : দীঘিনালায় মাইনী নদীর তীরবর্তী প্রায় ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি মেরুং ইউনিয়নের শত শত পরিবার। এছাড়া বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে মেরু বাজার। এতে দীঘিনালার সঙ্গে রাঙ্গামাটির লংগদুর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ডুবে গেছে ফসলের জমি-বীজতলা। এতে নিঃস্ব হওয়ার শঙ্কায় ইউনিয়নের শত শত কৃষক। বন্যাদুর্গতরা জানান, এর মধ্যে তারা কেবল ১০ কেজি চাল ও আধা কেজি ডাল পেয়েছেন। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে তাদের।
কুড়িগ্রাম, চিলমারী, নাগেশ্বরী, উলিপুর ও ফুলবাড়ী : জেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনে ৭২৫টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া শত শত একর আবাদি জমি নদীতে ভেঙে যাচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কাঁচা-পাকা সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্টের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো কোনো বসতঘরে হাঁটুপানি হওয়ায় লোকজন চৌকি উঁচু করে রাত্রীযাপনসহ রান্নাবান্না করছেন। প্লাবিত এলাকার মানুষ গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। অনেকে বাঁধের রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। স্রোতের তোড়ে অনেকের পাটের জাগ ব্রহ্মপুত্র নদে ভেসে গেছে। পুকুরের পাড় ডুবে গিয়ে ভেসে গেছে মাছ। উলিপুরে ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে এখনও সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো সাহায্য পৌঁছেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ডিমলা (নীলফামারী) : ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উজানের ঢল সামাল দিতে খুলে রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। এদিকে বন্যায় বসতঘর প্লাবিত হওয়ায় মানুষজন তিস্তার ডান তীর বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানিতে ভেসে আসা বিষধর সাপের কামড়ে মোর্শেদা বেগম (৩০) নামের এক গৃহবধূ প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি ডিমলা উপজেলার খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের তিস্তার চর পূর্ব বাইশপুকুর গ্রামের আমিনুর রহমানের স্ত্রী।
জামালপুর, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ : দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীর বাঁধ (দেওয়ানগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলপথ) ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রচণ্ড সে াতে ভেসে গেছে বাড়িঘর ও কৃষকের পাটের জাগ। এতে হাহাকার দেখা দিয়েছে ২ শতাধিক পরিবারে। এছাড়া ইসলামপুরসহ জেলার অন্যান্য উপজেলায় প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দুর্গত এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাসভাসি মানুষ।
সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও জগন্নাথপুর : সরকারি হিসাবে জেলার ৭ উপজেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হওয়ার কথা বলা হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, জেলায় প্রায় অর্ধ লাখ পরিবার পানিবন্দি। এসব মানুষ বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ঘরবাড়ি, হাটবাজার ও রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অনেকের ঘরে পানি প্রবেশ করায় রান্নাবান্না ও প্রাকৃতিক কাজ নিয়ে মহাবিড়ম্বনায় পড়েছেন। নিজেদের পাশাপাশি গবাদিপশুর নিরাপত্তা ও খাদ্য নিয়েও বিপাকে আছেন তারা। জেলার ২৩৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এখনও পানি নামেনি। ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং সেখানে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা পুলিশ সুপারের বিশেষ উদ্যোগে বন্যাকবলিত আরও দুই শতাধিক পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সিলেট, গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও জকিগঞ্জ : বিশ্বনাথে সুরমা নদীর বাঁধের উপর দিয়ে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে ২২টি গ্রাম। এসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাটবাজারেও পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া ভেসে গেছে কৃষকের আউশ ধান ও বীজতলা। গোলাপগঞ্জের হাওর-বিলবেষ্টিত শরীফগঞ্জ, বুধবারীবাজার, বাদেপাশা, বাঘা, ভাদেশ্বরের একাংশ ও আমুড়ার একাংশ তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট। জকিগঞ্জে সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে, বারহাল ইউনিয়নের নুরনগর এলাকায় ডাইক ভেঙে ও নিজগ্রামে ডাইক উপচে গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। কুশিয়ারা নদীর বিরশ্রী ইউনিয়নের পীরনগর এলাকায় ডাইক ভেঙে বন্যা দেখা দিয়েছে। জকিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম আহমদ জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১০টি ঝূঁকিপূর্ণ ডাইকে কাজ চলছে।
মৌলভীবাজার ও কমলগঞ্জ : শুক্রবার রাত ২টার দিকে কমলগঞ্জ পৌরসভার রামপাশা এলাকায় ধলাই প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের ২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘটনাস্থলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, আপাতত বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামতের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। পানি কমলে কাজ শুরু হবে। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দি পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
গাইবান্ধা : সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা এবং সদর উপজেলায় নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং বিভিন্ন চরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনও দেখা দিয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজ জানান, ফুলছড়ি ইউনিয়নের দেলুয়াবাড়ি, জামিরা, গজারিয়া ইউনিয়নের গলনা, ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারি ও কাউয়া বাঁধায় গত এক সপ্তাহে শতাধিক ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার হয়েছে। এছাড়া সদর উপজেলার রায়দাসবাড়ি ও কামারজানি এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, কাপাসিয়া ও চন্ডিপুর এলাকায় ব্যাপক ভাঙন চলছে। ওই সব এলাকায় গত এক সপ্তাহে ৮৫টি ঘরবাড়ি এবং প্রচুর ফসলি জমি তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।
শেরপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলার ঝিনাইগাতী সদর, ধানশাইল, মালিঝিকান্দা, গৌরীপুর ও হাতিবান্দায় প্রায় ৩০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নিমজ্জিত হয়েছে কৃষকের বীজতলা। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকার রাস্তাঘাট, ছোট ছোট পুল-কালভার্ট, কাঁচা-পাকা বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। প্লাবিত এলাকার লোকজন গৃহপালিত পশু নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। বাড়িতে পানি ওঠায় চুলা জ্বালাতে পারছেন না বাসিন্দারা। কয়েকটি এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
হবিগঞ্জ ও নবীগঞ্জ : নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধ উপচে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। নবীগঞ্জের পারকুল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কুশিয়ারা ডাইকে মেরামতের কাজ পুনরায় শুরু করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
নেত্রকোনা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও বারহাট্টা : শনিবার বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য সরকারিভাবে আরও ত্রাণের চাল বরাদ্দ দেয়াসহ শুকনো খাবারের প্যাকেট পাঠানো হয়েছে। দুই উপজেলার কয়েকশ’ গ্রামের লোকজন পানিবন্দি। উপজেলা সদরের সঙ্গে জেলার অন্যান্য এলাকার সড়ক যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে প্রায় দেড় হাজার ফিসারির মাছ।
লালমনিরহাট : শুক্রবার মধ্যরাত থেকে হু হু করে পানি ঢুকতে শুরু করে হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে। বিশেষ করে হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, সানিয়াজান, সিন্দুর্না, সিঙ্গিমারী, ডাউয়াবড়ি ও পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে জেলার ৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদিকে প্রবল পানির তোড়ে হাতীবান্ধা-বড়খাতা বাইবাস সড়কটির দুই জায়গায় ৩০০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। ফলে ওই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের সঙ্গে হাতীবান্ধা উপজেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
রাঙ্গামাটি : বন্যায় ভাসছে জেলার বাঘাইছড়ি ও বরকল উপজেলা। এছাড়াও লংগদু, নানিয়ারচর ও জুরাছড়ি উপজেলার বেশকিছু নিচু এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে।
বগুড়া : সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীতে শনিবার বিকাল ৩টায় পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে উপজেলার চরাঞ্চল কামালপুর, রহদহ, ঘুঘুদহ, চন্দনবাইশা, ধলিরকান্দি ও কুতুবপুরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজির ক্ষেত।
চকরিয়া (কক্সবাজার) : চকরিয়া ও পেকুয়ায় এখনও লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। পাহাড়ি ঢলের তীব্র স্রোতের কারণে মাতামুহুরী ব্রিজ ও বেতুয়াবাজার ব্রিজ চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। পেকুয়া সদর ও শীলখালীতেও ঘরে ঘরে বন্যার পানি উঠেছে। চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুদ্দিন মো. শিবলী নোমান জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চলছে।
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) : চন্দনাইশে শঙ্খ নদীর বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৮০ হাজার লোক। বিভিন্ন এলাকায় বেগুন, কাঁচামরিচ, ঝিঙে, করলাসহ বর্ষাকালীন সবজিক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার দোহাজারী-লালটিয়া সড়ক, গাছবাড়িয়া-ছৈয়দাবাদ সড়ক, দোহাজারী স্টেশন রোড, দোহাজারী-দেওয়ানহাট সড়ক, কাঞ্চনাবাদ রেলওয়ে স্টেশনরোড সড়ক, বাগিচাহাট-সাতবাড়িয়া-বৈলতলী সড়ক ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : উপজেলার প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর, তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদিকে পানিবন্দি মানুষের মাঝে দু’দিন ধরে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
রংপুর ও কাউনিয়া : জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বালাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, বৃহস্পতি ও শুক্রবারের চেয়ে শনিবার উজানের ঢলের গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। চরাঞ্চল গ্রামসহ নদীতীরবর্তী ঢুষমারা, গোপিডাঙ্গা, পাঞ্চরভাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, তালুক সাহাবাজ গ্রামে ১ হাজার পরিবারের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। পানির স্রোতে কালিরহাট-মধুপুর রাস্তা ভেঙে গেছে। প্রায় ৩০টি মাছের খামার তলিয়ে গিয়ে সব মাছ বেরিয়ে গেছে।