গত ২৫ নভেম্বর দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘শিক্ষকদের পিকনিকের টাকা জোগাতে বিনামূল্যের বই বিক্রি’। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয় কমিটি পুরাতন খাতা বিক্রি করার সময় বিনামূল্যে বিতরণযোগ্য সরকারি পুরাতন বই বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু, সরকারি বই পুরাতন হলেও তা বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, পত্রিকায় ছবিসহ যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, শুধু সেই প্রতিষ্ঠানই কি সরকারি বই বিক্রি করেছে, নাকি আরও কোনো প্রতিষ্ঠান করেছে ও করছে? যিনি পুরাতন বই ক্রয় করে ট্রাক ভর্তি করেছেন তাকে অনুসরণ করা হলে হয়ত তার গোডাউনে গিয়ে আরো অনেক সরকারি বই পাওয়া যাবে। তার মতো অন্যান্য ব্যবসায়ীদের খোঁজখবরও পাওয়া যাবে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নিশ্চয়ই এমন আরো অনেক বই ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য পাওয়া যাবে। জানা যাবে, আর কোন কোন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা থেকে সে/তারা বই কিনেছে? কোনো শিক্ষা অফিস থেকে সরকারি পুরাতন বই কিনেছে কিনা? আরও জানা যাবে, যারা সরকারি পুরাতন বই বিক্রি করে পত্রিকায় শিরোনাম হয়নি তাদের পরিচয় ও সংখ্যা।
বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে এবং আমার কাছে আসা একাধিক টেলিফোন থেকে জানা যায়, সরকারি পুরনো বই বিক্রির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নয়। পুরাতন কাগজ ক্রয় করে এমন একাধিক ব্যক্তি আমাকে প্রতিবছরই ফোন করে পুরাতন বই বিক্রির প্রস্তাব দিয়ে থাকে। তারা কোথা থেকে আমার ফোন নম্বর পায় এমন প্রশ্ন করলে জানায়, সব স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ফোন নম্বরই তাদের কাছে আছে এবং তারা সবাইকেই ফোন করে পুরাতন বই-খাতা কিনে থাকেন। কয়েকদিন আগেও আমাকে একজন ফোন করে বলেছেন, পুরনো বই-খাতা থাকলে আমাদের দিয়ে দেন স্যার। আমরা রেট ভালো দেবো। এখন কাগজের রেট ভালো আছে। বর্তমানে প্রতি কেজি বই ৪৫ টাকা এবং প্রতি কেজি খাতা ৫৫ টাকা দরে নেওয়া যাবে। পরে হয়তো এই রেট নাও থাকতে পারে। আপনার কোনো সমস্যা হবে না স্যার। আপনি যখন বলবেন তখনই আমরা এসে নিয়ে যাব।
যদি পুরাতন কাগজ ব্যবসায়ীদের এসব বক্তব্য শতভাগ সঠিক নাও হয়; তথাপি এটি পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, সারাদেশে অনেক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সরকারি পুরনো বই বিক্রি করে থাকে। শুধু যে পিকনিক করার জন্য বা আর্থিক অনটনের জন্য অথবা অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য এ সব বই বিক্রি হয়ে থাকে তা নয়। আর্থিক অনটন বা অবৈধ অর্থ উপার্জন ছাড়াও এর সঙ্গে বেশ কিছু কারণ জড়িত।
বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, প্রতিবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিচের শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যাকে ভিত্তিতে করে তার সাথে ফাঁকা আসনের বিপরীতে সম্ভাব্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা যোগ করে ওপরের ক্লাসের বইয়ের আনুমানিক চাহিদা দিয়ে থাকে। যেমন, একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে যত জন শিক্ষার্থী থাকে তার সাথে আগামী বছর পঞ্চম শ্রেণিতে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হবার সম্ভাবনা থাকে তা যোগ করে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের চাহিদা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক ও/বা প্রথম শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে কতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে তা সম্পূর্ণ প্রত্যাশার ভিত্তিতে অবাস্তব অনুমান করে বইয়ের চাহিদা দেওয়া হয়। অন্যান্য শ্রেণিতেও আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে প্রত্যাশার ভিত্তিতে বইয়ের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ তারা কিছু বাড়তি বইয়ের চাহিদা দিয়ে থাকে যাতে শিক্ষার্থীরা ওপরের ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে বা নতুন ভর্তি হয়ে নতুন বই পেতে বিলম্ব/অসুবিধা না হয় এবং শিক্ষার্থীদের মন খারাপ না হয়। কেননা, আগে থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায় না, কোন ক্লাসের কতজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হবে, কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে, কতজন নতুন শিক্ষার্থী এসে ভর্তি হবে। পরবর্তীতে সব শিক্ষার্থী প্রমোশন না পেলে, কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়লে ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে বিভিন্ন শ্রেণির কিছু কিছু বই অতিরিক্ত থেকে যায়। বিশেষ করে কোভিড ১৯ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ ও ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের অনেক বই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এই বাস্তব কারণে অতিরিক্ত থেকে যাওয়া কয়েক বছরের বই থানা/ উপজেলা শিক্ষা অফিস ফেরত না নিলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই স্থান সংকুলান সমস্যা হয় এবং অযত্নে বিনষ্ট হয়।
আবার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া একাধিক বছরের বই একত্রে থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসে রাখার জায়গাও পর্যাপ্ত নেই। কেননা, প্রতি বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষা অফিসে নতুন বই রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা প্রয়োজন হয়। তাই অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে পুরাতন বই বিক্রি করে দিতে চায়। কিন্তু বৈধভাবে তা করতে পারে না!
এমতাবস্থায় অব্যবহৃত সরকারি পুরাতন বই বিক্রি করার জন্য প্রতি বছর বাজার দর যাচাই করে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে একটি সরকারি আদেশ জারি করা আবশ্যক। সেই আদেশটি হতে পারে এমন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজে এক বছরের অধিক পুরাতন বই বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা সরকারি কোষাগারের নির্দিষ্ট হিসাব নম্বরে জমা দেবে। সেই সাথে কোন কোন শ্রেণির কোন কোন বিষয়ের মোট কতটি বই কত কেজি হয়েছিল তার একটি ছকবদ্ধ হিসাব অনলাইনে ও হার্ডকপিতে জমা দেবে। যাতে তাদের প্রদত্ত বইয়ের চাহিদা, ব্যবহৃত বইয়ের সংখ্যা ও অব্যবহৃত বইয়ের সংখ্যা তুলনা করে সিস্টেম লস নির্ধারণ করে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়। অথবা এর চেয়ে উত্তম হতে পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক বছরের অধিক অব্যবহৃত সব পুরাতন বই নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসে জমা দেবে। শিক্ষা অফিস সে বই প্রতি বছর নিলামে বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেবে এবং সেইসাথে বিক্রিত বইয়ের ছকবদ্ধ হিসাব অনলাইনে ও হার্ডকপিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিবে। এতে সরকারি পুরাতন বই অবৈধভাবে বিক্রির সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে এবং নতুন বই সযত্নে রাখার শূন্যস্থান বৃদ্ধি পাবে।
তাছাড়া বইয়ের চাহিদা নেওয়ার সময়ও এমন আদেশ থাকতে হবে যেনো, কোনভাবেই অস্বাভাবিক অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা কেউ দিতে না পারে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক ট্রাক অব্যবহৃত বই থাকা কোনোভাবে স্বাভাবিক সিস্টেম লস নয়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিভিত্তিক প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যাসহ প্রায় সকল তথ্যই শিক্ষাবিভাগে বিদ্যমান। কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, থানার/উপজেলার ও জেলার বিগত কয়েক বছরের প্রকৃত শিক্ষার্থী হ্রাস-বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করলেই সংশ্লিষ্টদের বইয়ের স্বাভাবিক চাহিদা নির্ধারণ করা সম্ভব; যাতে সামান্য সিস্টেম লস থাকতে পারে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা দিলে তাও আইডেন্টিফাই করা সম্ভব। নতুন শিক্ষাবর্ষে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসা ঘটলেও একটি থানার/উপজেলার বা জেলার মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি হেরফের ঘটে না। শহরের তুলনায় গ্রামে এই হেরফের আরও কম থাকে। তাই অস্বাভাবিক অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা দেয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, থানা/উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, সাধারণ জনগণের টাকায় ছাপানো এ সব বই অপচয় করা মানেই সরকারি সম্পদের অপচয় করা। এক্ষেত্রে কারো উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও দুর্ভিসন্ধি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয়।
লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।