একযোগে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থাকে দেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বলা যায়। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার সঙ্গে আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের আগে এক চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন নিয়ে দর-কষাকষির ফোনালাপ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় তাঁর পদে থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ সামনে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদের মুখে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রক্টরের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধ অভিযোগের ভিত্তিতে আন্দোলনের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর উপাচার্য প্রক্টরকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন।সোমবার (৭ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
এভাবে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। ফলে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্রমেই ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব কারণে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যদের সঙ্গে এক মিটিংয়ে এ বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিশেষ করে সরকারের ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলমান থাকলেও উপাচার্যদের অন্যায়, অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এবং সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোর আধিপত্যের লড়াই নিরসনে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি যে-ই করুক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, নিজের দলের হলেও তাকে রেহাই দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে সব ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর হচ্ছে কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো—সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ অনিয়ম, অন্যায়ের অভিযোগ প্রায়ই আমাদের সামনে আসছে। এখন এর পরিমাণ আরো বেড়েছে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের কথাও বেশি বেশি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে আমলে নিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বহু প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আসা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মূলত এসব ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলেই অনিয়ম করেও অনেকে সেটির বৈধতা পেয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারপন্থী প্রশাসন বিদ্যমান রয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব অনিয়মের দায়ভার সরকারের ওপর বর্তাচ্ছে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অনিয়ম ও অনৈতিকতার ইস্যুতে সংগত কারণেই সরকারের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার দিকে সাধারণের আঙুল উঠেছে। আর এই আঙুল ওঠার পেছনেও বেশ কিছু যৌক্তিকতা কাজ করছে। সেগুলো হলো—১. কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কারো বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ উত্থিত হলেও সে বিষয়টি যথাযথভাবে আমলে না নেওয়া; ২. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সহজে তাঁর পদ থেকে না সরিয়ে মেয়াদ পূর্ণ না হওয়ার অজুহাত দেখানো; ৩. অভিযুক্তকে সহজে পদ থেকে সরিয়ে দিলে সরকারের ভাবর্মূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কার প্রবণতা; ৪. বিভিন্ন পদে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও একই ব্যক্তিকে বারবার পদে অধিষ্ঠিত করা; ৫. অনেক ক্ষেত্রে অন্য দল (জামায়াত-বিএনপি) থেকে আসা হাইব্রিডদের পদে বসানো এবং ৬. পদস্থ ব্যক্তিকে আস্থাভাজন মনে করে তাঁর অনৈতিক কার্যক্রমকেও নৈতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা প্রভৃতি।
সম্প্রতি জাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ওপরের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি পদ থেকে সরবেন না। একজন উপাচার্য দীর্ঘ সময় ধরে পদে রয়েছেন, তবু কেন তাঁকে নানাবিধ অন্যায়-অপকর্মকে সমর্থন করে পদে বহাল থাকার অনৈতিক চেষ্টা করতে হবে—সেটি কোনোভাবেই বোধগম্য হয় না। অন্যদিকে রাবি উপ-উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্যের ফোনালাপের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাংশের প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। কিন্তু তিনি বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ক্রমাগত প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে নিজের নীতি-নৈতিকতার অবস্থান থেকে পদ থেকে সরে যাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় পদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো কর্ণপাত লক্ষ করা যায় না। ওপরের নির্দেশ আসার অপেক্ষায় তাঁরা স্বপদে বহাল থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থা বিরাজ করার পেছনে আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বড় কারণ হলো—উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি না হওয়া। সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে অনেকেই উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য হচ্ছেন। যে কারণে তাঁরা সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা ইউজিসিকে শুরু থেকেই খুশি করার তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকেন। আর এই খুশির বেড়াজাল সহজে কেউই ভাঙতে পারেন না।
বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক অগ্রযাত্রা থাকলেও বিভিন্ন পর্যায়ে কতিপয় তথাকথিত সরকারদলীয় তোষামোদকারী ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে যথাযথ সুশাসন বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সরকার যদি প্রকৃতপক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বর্তমানে চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু অভিযোগ কিংবা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, যথাযথ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আগেই এসব দুর্নীতিবাজকে উত্খাত করতে হবে।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়