প্রায় তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গত দুই বছরেই খোলা হয়েছে ১১টি বিভাগ। যদিও নতুন চালু এসব বিভাগের নেই নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ। নিজস্ব ল্যাবের পাশাপাশি ব্যবস্থা হয়নি শিক্ষকদের বসার কক্ষেরও। এ অবকাঠামো সংকটের মধ্যেই প্রস্তুতি চলছে আরো আটটি বিভাগ খোলার। এসব বিভাগের বেশিরভাগেরই নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণিকক্ষ নেই। কখনো অন্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষে, কখনো গাছতলায় বা টিএসসিসির করিডোরেও ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। দেখা যাচ্ছে, নতুন প্রতিষ্ঠিত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই ধরনের সমস্যা প্রকট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। আবার, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তৈরি হচ্ছে নানা সংকট। শিক্ষার্থী বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি তাদের সুযোগ-সুবিধা।
গেল কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার মানোন্নয়ন বা অবকাঠামোগত অন্যান্য দিকে গুরুত্ব না দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরই আসন সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে, খুলছে নতুন নতুন বিভাগ। শুধু শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকদের বসার রুমই নয়, কম্পিউটার কক্ষ, গবেষণাগার, লাইব্রেরিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। এতে একদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর যেমন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান। অতীতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ প্রয়োজন পূরণ করলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সমস্যায় ডুবে আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার অতীতের উজ্জ্বল ইতিহাস প্রায় হারাতে বসেছে। তাই শিক্ষা ও গবেষণার বিকাশে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন পূরণ হয়। তাদের চাহিদা পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সচেষ্ট হতে হবে।
নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে অপর্যাপ্ত পরিবহন ও আবাসিক সংকট। শিক্ষার্থীদের জন্য যে হলগুলো রয়েছে তাতে স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করে। তাতেও নেই পড়ার কক্ষ, গ্রন্থাগার, অতিথি কক্ষ, ওয়াইফাই সুবিধা, ক্যান্টিন ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য বাসগুলো অপর্যাপ্ত এবং সেইসঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে অপর্যাপ্ত আসনের গ্রন্থাগার। আবার, চিকিত্সাসেবার মানও উল্লেখ করার মতো নয়। এসব পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে যে শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হচ্ছে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
চলমান সমস্যার জুতসই সমাধানে প্রয়োজন শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিকল্পিতভাবে আসন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চিঠিতে শিক্ষার্থীদের আসন না বাড়ানোর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ঠিক, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বাড়ছে। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসন সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাধ্য হচ্ছে। খোলা হচ্ছে নতুন নতুন বিভাগ। তবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণাগার উন্নয়ন, শ্রেণিকক্ষের পরিসর বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় আবাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি অবকাঠামোগত সংস্কার ব্যতিরেকে কেবল আসন সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক নয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের উদ্যোগ শিক্ষার গুণগত মানকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে কেবল সরকারের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে চলবে না, বিশ্ববিদ্যালয়বান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে গবেষণাধর্মী কাজের দিকেও। পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়িয়েও লাভ নেই।
আমাদের শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে সর্বাগ্রে দরকার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের মান উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকদের পাঠদানের যোগ্যতা, পাঠ্যক্রম, পাঠদানের পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষায় আধুনিকীকরণ, শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার মান । এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতেই সরকারসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আগে এশিয়া কিংবা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ছিল। এখন এই তালিকায় তাদের কোনো অবস্থান নেই। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বিষয়টি ক্রমে আমাদের শিক্ষার দৈন্যকে প্রকাশ করে। একুশ শতকের উপযোগী শিক্ষা ও উন্নয়ন সহায়ক মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা নতুন বিভাগ খোলার বিষয়টিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মান ও পরিধি বাড়াতে হবে। জাতীয় বাজেটে যেমন উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, তেমনি অতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াতে হবে। আবার প্রয়োজনে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিকেও মনোযোগী হতে হবে। তবে, সেক্ষেত্রে গুণগত মান রক্ষা ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমি জোর দিয়ে যে কথাটা বলতে চাই, পড়ালেখার ক্ষেত্রে গুণগত মান পানির স্তরের মতো নিচে নেমে যায়নি। অথবা উড়ে যায়নি কর্পূরের মতোও। শিক্ষার মান ও শিক্ষাগত পদ্ধতির ব্যাপারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এখনো শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। আগের যুগে জিপিএ পদ্ধতি ছিল না। প্রতি শিক্ষাবোর্ড থেকে মাত্র ২০ জন করে শিক্ষার্থী বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান পেতো। আমার মনে আছে, আমার দেখা এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী, যারা বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান করেছিল, পরবর্তীকালে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে। আবার প্রথম বিভাগ না পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফল লাভ করে পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা বিসিএসে সেরা হয়েছে। বর্তমানেও বিরাজ করছে একই অবস্থা। আমাদের শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে সর্বাগ্রে দরকার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক।
দেশে প্রতিবছর উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকুলান হয় না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সেসব প্রতিষ্ঠানও যে খুব ভালো চলছে তা বলা যায় না। উচ্চশিক্ষা প্রসারের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সরকার প্রতিবছর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিপুল পরিমাণ টিউশন ফি দিয়ে প্রতিবছর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অকল্যান্ড, কানাডা, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও এ সম্ভাবনাটা প্রবল। কেবল রাজধানীতে এসব বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে উচ্চশিক্ষার সুযোগটা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে। বর্তমানে জেলা পর্যায়েও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য রয়েছে। কিন্তু যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাব, অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক ভাবনার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হচ্ছে। এর পরিবর্তন আবশ্যক। সেক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা বা অধ্যাদেশেরও পরিবর্তন প্রত্যাশিত।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষা-উপকরণ, গবেষণাগার, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ প্রভৃতি বিষয় আবশ্যিক করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে। হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। ভাড়া করা বাড়ি, ঘিঞ্জি পরিবেশে যত্রতত্র গড়ে উঠছে এসব প্রতিষ্ঠান। এমনকি রাজধানীর বাইরে মূল ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা নির্ধারণ করা হলেও গত কয়েক বছরে তার বাস্তবায়ন তেমন হয়নি। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার মানোন্নয়ন অতীব জরুরি। বিশেষত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা পদ্ধতির মানোন্নয়ন অপরিহার্য। কচি শিশুরা আগামী দিনের নেতৃত্বের বাহক। শিশু বয়স থেকেই তাদের চেতনায় দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম, ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা জরুরি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, কৃষ্টি-সংস্কৃতির পাশাপাশি সমকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকতে হবে। সমকালের আলোয় জীবনকে দেখতে জীবন সংশ্লিষ্ট ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে কেবল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনে উত্সাহিত করতে পারেন, আর কেউ নয়। শিক্ষকরাই তাদের যথাযথ ও সুষ্ঠু শিক্ষা প্রদান করতে পারেন— হতে পারেন তাদের জীবনের আদর্শ। অভিভাবক, সরকার এমনকি শিক্ষকগণকেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে।
শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। প্রথম প্রশ্ন শিক্ষা বলতে তত্ত্ব, তথ্য, পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ জ্ঞানকেই বুঝবো? না কে কতো বেশি নম্বর পেয়ে বড় বড় সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পেরেছে তাই বুঝবো? জানা মতে এই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে এমনকি মন্ত্রণালয়েরও সম্ভবত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। থাকলে এই দুর্দিনে তার বিবরণ পাওয়া যেতো নিশ্চয়ই। আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষার সকল পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। এই যে বাড়তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানে মানসমৃদ্ধ শিক্ষা বাস্তবায়িত করতে না পারলে তা আশাব্যঞ্জক না হয়ে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে—যা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়।
লেখক :সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক