দেশের বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মাসেই কমিটি দেওয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি শুরু করতে যাচ্ছে সংগঠনটি। এদিকে ছাত্রলীগের কমিটি করার খবরে একধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের মধ্যে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা মনে করছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নেই এমন কথা বলা যাবে না। রয়েছে নীরব রাজনীতি। সরব রাজনীতি না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছেন। এই প্রবণতা বন্ধ করতে সেখানে ছাত্রলীগের ছাত্ররাজনীতির চর্চা উন্মুক্ত করার দাবি করছেন তাঁরা। গত রোববার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায়ও এ দাবি জানান ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।
তবে ছাত্ররাজনীতির চর্চা শুরু হলেই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের মতো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা মনে করেন না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক ও শিক্ষাবিদেরা। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে যে হানাহানি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, তাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও বড় রকমের ক্ষতির শিকার হতে পারে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের যে জোর করে রাজনীতি করানোর প্রবণতা, কর্মসূচিতে না গেলে মারধর ও হানাহানি এসব ঘটনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ছাত্রলীগ যদি আসে, তাহলে অন্যদেরও না করা যায় না। আর প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে মারামারি, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, টেন্ডারবাজির একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তাই এই রাজনীতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে সেখানে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থাকে।[insaide-ad]
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-মালিকদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবীর হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো হবে, সেটা বলা মুশকিল। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি নেই। এই না থাকার কারণে যে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়েছে, এমনটিও নয়।
সরকারের সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান বলেন, ছাত্ররাজনীতির কারণে গত ছয় মাস কিংবা এক বছরে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়নি। আমরা চাই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম থাকবে। তবে এই বক্তব্যের সত্যতা বাস্তবে পাওয়া যায়নি।
গত এক বছরে (১৫ জুলাই ২০১৫ থেকে গতকাল বুধবার (২০ জুলাই) পর্যন্ত) একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে অন্তত ৮৭টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নয়জন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। সর্বশেষ বুধবার(২০ জুলাই) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা ধর্মঘট ডেকে পরিবহন চলাচলে বাধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অচল করে দেন।
অন্যদিকে গত এক বছরে শুধু ছাত্রলীগের সংঘর্ষের কারণে বন্ধ হয়েছে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশালের শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ।
এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ নভেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ছয় বছরে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৫৪ জন নিহত হন। নিজ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতেই মারা গেছেন ৩৯ জন। এই সময়ে ছাত্রলীগের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় একাধিকবার বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চারবার এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় তিনবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে।
এদিকে ছাত্রলীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে। সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সরদার মোহাম্মদ রেফাত বলেন, এই শাখার অধীনে ২২টির মতো কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি দেওয়ার পরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের মুখে পড়তে হয়েছে। এমনকি ২০১৩ সালে শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির সবাইকে বহিষ্কার করা হয়। এভাবে যতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়, সব কটিতেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়।[insaide-ad]
এসব বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের কোষাধ্যক্ষ ইসফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমরা যে ছাত্ররাজনীতি দেখে অভ্যস্ত, তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হলে শিক্ষার মান আরও কমে যাবে। এর ফলাফল ভালো হবে না। তবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হতে পারে।
একাধিক শিক্ষক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকের সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, ছাত্ররাজনীতির বর্তমান যে ধারা, তাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামোয় অনুপযুক্ত। সেখানে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে সহিংসতা, অরাজকতা ও হানাহানির মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
ছাত্রলীগের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা হয়। বারবার বন্ধের মুখে পড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আমরা এমনিতেই জঙ্গি ইস্যুতে ঝামেলায় আছি। এখন আবার ছাত্রলীগের আগমনের খবরে নতুন আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি চালু করা সঠিক হবে না। মৌলিক ছাত্ররাজনীতি হতে পারে। যেমনটি ৫০-৭০-এর দশকে ছিল। তবে এটা নির্ভর করবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী মনে করে, তার ওপর।