ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপালের সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া দুটি ফোনালাপ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রথম ফাঁস হওয়া ফোনালাপটিতে তিনি বেশ কয়েকবার তাঁর অবস্থানের সঙ্গে মানানসই নয় এমন সব শব্দ উচ্চারণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই নিম্নরুচির শব্দ প্রয়োগের ফলে সারা দেশের শিক্ষক ও অভিভাবক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক সমাজের উঁচু মাথাটা যেন নীচু হয়ে গিয়েছে। যদিও অধ্যক্ষ দাবি করেছেন, এগুলো সুপার এডিট করা।
ভিকারুননিসা স্কুলটি সারাদেশের মধ্যে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করা একটি প্রতিষ্ঠান। তার সুনাম যেন কস্তুরির সুবাসের মত ছড়িয়ে পড়েছে দেশবিদেশে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান প্রধানের এমন অমার্জনীয় শব্দে আমরা সবাই হতচকিত।
প্রতিষ্ঠানটি মূলত অধ্যক্ষ হামিদা আলীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারঁ চলে যাওয়ার পরে এখানে একজন দক্ষ অধ্যক্ষের অভাব সবসময়ই ছিল।
বিদ্যালয়টির সুনামের কারণেই এখানে সবসময়ই ভর্তির একটা চাপ ছিল। যেহেতু দেশের প্রভাবশালীদের মেয়েরা এখানে লেখাপড়া করে, এখানকার গভর্নিং বডির সদস্যরাও যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাদের মধ্যে অনেকেই অনৈতিক সুবিধা আাদায় করার জন্য অধ্যক্ষের প্রতি সর্বপ্রকার চাপ প্রয়োগ করেন। জানামতে আগের অধ্যক্ষদের অনেকেই তাদের চাপে নতি স্বীকার করে কিছু সুবিধা দিয়ে তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতেন।
এ পর্যন্ত এভাবে একটা সমঝোতার মাধ্যমেই ভিকারুননিসা স্কুল চলছিল। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তখনই যখন এই করোনার সময়ে কামরুন নাহার মুকুল অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। তিনি তাদের অনেকের অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করে দেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে তিনি বাড়তি ভর্তি বন্ধ করে দেন। ডেপুটেশনে আসা শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যক্ষরা সাধারণত আইনের বাইরে যেতে চান না। কারণ তারা তাদের চাকরিতে সামান্য পরিমানের কালিমালিপ্ত হোক তা চান না। আমার বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রিন্সিপালও ডেপুটেশনে এসেছেন। তার আগেরজনও এভাবে এসেছিলেন। তাদেরকে দেখেছি একাডেমিক বিষয়গুলোর ওপরই খুব বেশি জোর দিতে।
কয়েকজন শিক্ষক অভিভাবক থেকে জানলাম, ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের জন্য স্থায়ী আবাস কিনলে শিক্ষকদের বেতন দিতে সমস্যা হবে। তাই সাধারণ শিক্ষকরা এটি এ মুহূর্তে কেনার বিরোধিতা করে আসছিল। এ অবস্থায় অধ্যক্ষ সাধারণ শিক্ষকদের পক্ষ নেন। তিনি কোনো এক সদস্যের কাছে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচের হিসেব চেয়ে বসেন। শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি কোনো বেতন-ফি বন্ধ করেন। অধ্যক্ষের এমন সিদ্ধান্তের ফলে গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য তার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন। অভিভাবক ফোরাম থেকে দরখাস্ত দেয়া হয় ভর্তির সুবিধা দেয়ার জন্য। অধ্যক্ষ সেটিও মেনে নেন নি।
এসব কারণে সুবিধাভোগী শ্রেণী সবাই এক হয়ে যায়। যদিও অভিভাবকদের অনেকেই গরুর হাটের কারণে অধ্যক্ষের ওপর বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা তার শক্ত অবস্থানকেও সাপোর্ট করেছেন। ইউটিউবে দেখলাম, যে ভদ্রলোক বলেছিলেন যে তিনি ফোনালাপ ফাঁস করেছেন, আজ তিনি সুর নরম করে বলছেন যে তিনি নিজে তা ফাঁস করেন নি। কোন মিডিয়ার লোক পাশে ছিল। ফোনালাপটি অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। প্রথম অংশে ঐ ভদ্রলোক গভর্নিং বডির মেম্বারদের দায়ী করে কিছু বলেছেন। অধ্যক্ষও তখন রেগে এসব বলেছেন। মনে হয়েছে অধ্যক্ষকে ফাঁদে ফেলতেই এসব আয়োজন। পরে অধ্যক্ষ সুবিধা দিতে না চাইলে তাকে পদ থেকে সরাতেই এই ব্যবস্থা।
একপক্ষ অন্যপক্ষের অনুমতির বাইরে ফোনালাপ ফাঁস করা ভীষণ রকমের বেআইনী কাজ। সংক্ষুব্ধ হলে পুলিশের কাছে গিয়ে ফোনালাপ দেখানো যাবে, কেস করা যাবে। কিন্তু কোনো মিডিয়ায় ফাঁস করা যাবেনা। যদিও আমাদের দেশ এ ব্যাপারে উল্টোপথে হাঁটছে।
আমরা তাঁর সমালোচনা যেমন করেছি, আবার তার শক্ত অবস্থানের দিকটিও দেখা উচিৎ। মনে হচ্ছে তিনি এধরণের চাপ নিতে অভ্যস্ত নন। এটাকে ভিতর থেকেই আরেকটা গ্রুপ করে, অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে সমাধান করা যেত। কিন্ত যেহেতু তিনি একসময় রাজনৈতিক ঘরানার মানুষ ছিলেন সেভাবেই সমস্যাটি সমাধান করতে চেয়েছেন। আর তাই আজ তিনি আমাদের সমালোচনার মুখোমুখি। আর একটা কথা। শহর কিংবা গ্রামে যেসকল প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সাধারণ শিক্ষকদের সাথে কথা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই বলেছে যে তারা কমিটি নামক এক দুরাত্মার অতি অত্যাচারের শিকার। সুতরাং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে ম্যানেজিং কমিটির অবসান চাই।
সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সঠিক তদন্ত হোক। মানুষ মিডিয়ায় যা দেখে তাই বিশ্বাস করে এবং মন্তব্য করে। মিডিয়া ট্রায়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসুক প্রকৃত তথ্য। শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, যেহেতু ডেপুটেশন ব্যবস্থায় বাইরে থেকে কাউকে নিয়োগ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় না, তাই অধ্যক্ষ হামিদা আলীকে প্রধান করে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে একজন দক্ষ অধ্যক্ষ নিয়োগদান করে এই বিদ্যালয়টির সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থা করেন।
আশা করবো, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষ দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে শিক্ষক সমাজকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করবেন। আমরা তার সঙ্গেই আছি ততক্ষণ যতক্ষণ তিনি সাধারণ শিক্ষকদের জন্য লড়ে যাবেন।
লেখক : মো. মেজবাহুল ইসলাম প্রিন্স, মহাসচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি।