ভুলে যাবেন না, ‘কোটা’ আন্দোলনকারীরা আপনার আমার সন্তান - দৈনিকশিক্ষা

ভুলে যাবেন না, ‘কোটা’ আন্দোলনকারীরা আপনার আমার সন্তান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়ে হয়ে এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর ক’টা দিন পর বরাবরের মতো ভালো রেজাল্ট করে সে মাস্টার্স শেষ করবে। সেই সঙ্গে শেষ হবে তার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, তপস্যা। প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পার হয়েই তার ঝরে পড়ার কথা ছিল। তাকে হাই স্কুলে পড়ানোর মতো সঙ্গতি ছিল না তার দিনমজুর বাবার। শুধু তার শিক্ষকদের ঐকান্তিক অনুরোধ ও মায়ের জেদের কারণে বাপজান তাকে স্কুলছাড়া করেননি। তারপর স্কুল-কলেজের বেড়াগুলো একটার পর একটা টপকিয়ে সব শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মগডালে পৌঁছেছে সে। সে এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে—মেস-জীবন ও প্রাইভেট টিউশনির আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা জীবন থেকে মুক্তির। মা-বাবা, ভাই-বোনকেও তার স্বপ্নের কথা বলে সে।  বন্ধুরা বলে, তুই তো বিসিএস পরীক্ষা দিলেই নির্ঘাত একটা ভালো চাকরি পাবি, অবশ্য যদি...। সে জানতে চায়, অবশ্য যদি কী? (অবশ্য যদি ‘কোটার’ চক্করে না পড়িস।) বন্ধুরা তাকে ‘কোটা’ কী, কত প্রকার ও কী কী বুঝিয়ে বলে। শুনে আজীবন ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে, আড্ডাবাজি, রাজনীতিকে এক শ হাত দূরে রেখে, ক্লাসরুম-লাইব্রেরি-প্রাইভেট টিউশনির শিকলে বাঁধা জীবনে আত্মসমর্পিত ছেলেটি কেমন ধন্দে পড়ে। তাহলে কি চিরকাল একবেলা-আধবেলা খেয়ে-না খেয়ে মা-বাবা যে স্বপ্নের বুড়বুড়ি দেখে এসেছেন, সেগুলো বাতাসে উবে যাবে কর্পূরের মতো? শেষ হবে তার বিজয়রথের চলা? ঘাটে এসে ডুবে যাবে তরি?

বিষয়টি ভাবিয়ে তুলল তাকে এবং তার মতো আরো হাজারো ছাত্র-ছাত্রীকে। তাদের মনে হলো, সরকারি চাকরিতে এটা একটা বড় বৈষম্য, এক ধরনের প্রতারণা। তুমি যত মেধাবীই হও না কেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তুমি যতই কৃতিত্বের পরিচয় দাও না কেন, বিসিএস নামক সোনার হরিণ যে তোমার হাতেই ধরা দেবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তোমার চেয়ে অনেক খারাপ রেজাল্ট করেও ‘কোটার’ কারণে একজন প্রার্থী তোমার ন্যায্য পদটি পেয়ে যেতে পারে, তুমি পাবে না। ব্যাপারটি বিচলিত করল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সব শিক্ষার্থীকে, যারা কোটার আওতায় পড়ে না, যারা শুধু মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একটি চাকরি পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। আর এটাও ঠিক, সরকারি চাকরি সাম্প্রতিককালে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ও কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে সরকার কর্তৃক বেতন-কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নির্ধারণের ফলে। তা ছাড়া সরকারি চাকরির ঝুঁকিমুক্ত দিক তো আছেই। একবার ‘ইন’ হলে ‘আউট’ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, ‘সেঞ্চুরি’ করা যাবে নট আউট থেকে।

ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুরু হলো যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা ও গুঞ্জরণ। আলোচনা থেকে ক্রমে ক্রমে চারদিকে উঠল সমালোচনার ঝড়। বিশেষ করে মেধার ভিত্তিতে মোট পদের ৪৪% ও বিভিন্ন ‘কোটায়’ বাকি ৫৬% পদপূরণের নিয়মটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেল, ‘কোটা’ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য প্রার্থীদের চেয়ে অন্যদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠরা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে বারবার আনার পরও যখন কোনো ফলোদয় হলো না, তখন তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিল, গড়ে তুলল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন। এটি যে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, আরো সুনির্দিষ্টভাবে তাদের ক্যারিয়ারসংক্রান্ত একটি সংগঠন, তা তাদের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য-বিবৃতি থেকে স্পষ্ট। তারা ক্লাস বর্জন, রাজপথে অবস্থান ও বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে তাদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখল। তাদের দাবি ছিল একটাই : সরকারি চাকরিতে বর্তমানে প্রচলিত ‘কোটা’ব্যবস্থা ‘সংস্কার’ করতে হবে। এটাকে ৫৬% থেকে কমিয়ে ১০% করতে হবে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিপুল সমর্থন, লাগাতার ক্লাসবর্জন, উত্তরোত্তর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও রাজপথে জনদুর্ভোগ লক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ‘কোটা’ পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। তবে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথাও বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

লক্ষণীয়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ‘কোটা’ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিল, বাতিল নয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় তারা মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে যাওয়ায় সানন্দে তা গ্রহণ করল এবং দ্রুত ঘোষণাটির বাস্তব প্রতিফলন সংবলিত একটি প্রজ্ঞাপন জারির জন্য মোলায়েম দাবি জানাল।

এ পর্যন্ত আন্দোলন খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল। এর কোনো ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও’ লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ এর ভেতর রাজনীতি ঢুকে পড়েনি। সবই চলছিল ভালোয় ভালোয়। কিন্তু হঠাৎই যেন কালবৈশাখীর ঝাপটা লাগল শাহবাগ চত্বরে। পুলিশ এক প্রকার বিনা নোটিশে আন্দোলনকারীদের হটাতে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে বসল এবং টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ল। অনেককে আটক করল। তখন রাত প্রায় দশটা। যারা দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল এবং আন্দোলনও যখন একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশের এই সম্পূর্ণ অযাচিত ও অনভিপ্রেত হামলার জবাবে তারাও ঢিল-পাটকেল ছুড়ল এবং মুহৃর্তে শাহবাগ চত্বর একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। পুলিশের এই আকস্মিক হামলায় মনে হতে পারে, ক’দিন যাবৎই কোনো অ্যাকশনে না যেতে পেরে বোধ হয় তাদের হাত নিশপিশ করছিল। ফলে ‘তোমাদের নীরব আস্ফাালন অনেক সহ্য করেছি, আর না’ বলে ‘ইয়া আলী’ রব তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। রেজাল্ট : বেশ কয়েকজন ছাত্রকে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হতে হলো। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কতিপয় দুর্বৃত্ত বিনা কারণে অতর্কিতে আক্রমণ চালাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে। ভেঙ্গে চুরমার করল দামি আসবাবপত্র ও ভি. সি.’র ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ভি. সি. প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানালেন, মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল না, তারা ছিল প্রশিক্ষিত বহিরাগত গুণ্ডা এবং তাঁকে হত্যা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

২.

ছাত্রদের এই গান্ধীজি মার্কা আন্দোলন ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি থেকে কতকগুলো প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে সামনে চলে আসে : ১. এই আন্দোলন কি অযৌক্তিক? ২. ছাত্ররা রাজপথে নামার আগে প্রশাসন নাকে তেল দিয়ে কেন ঘুমাচ্ছিল? বিশেষ করে অতীতে পাবলিক সার্ভিসসহ অনেকেই যেখানে ‘কোটা’ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করেছেন বারবার। ৩. যখন আন্দোলনের স্তিমিত অগ্নিশিখা নিবন্ত হয়ে আসছিল, ছাত্র-ছাত্রীরা মোটামুটি হৃষ্টচিত্তে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে পুলিশ ‘যৌবনপ্রাপ্ত’ হয়ে জেগে উঠে আন্দোলনের ভস্মে কেন ঘি ঢালতে গেল, কেন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা-টিয়ার গ্যাস-রাবার বুলেট দ্বারা তাড়ানোর দরকার পড়ল? ৪. ভি. সি.’র বাসভবনে যখন মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করল তখন শাহবাগ চত্বরের পুলিশরা কি রণক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল? আশপাশের অবস্থানগুলো থেকে কি দ্রুত ‘রি-ইনফোর্সমেন্ট’ পাঠানো যেত না ভি. সি. ভবনে? ৫. পুরো ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বাহিনী ও শিক্ষককুল (দু’একজন সম্মানিত ব্যতিক্রম ব্যতীত) কি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন? অন্তত প্রথম দিকে?

এরপর ঘটল আরো দু’টি ন্যক্কারজনক ঘটনা। কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় দুর্ধর্ষ এক নেত্রীকে হল কর্তৃপক্ষ, তাদের ভাষ্য মতে, সাধারণ ছাত্রীদের রোষানল থেকে বাঁচাতে ও উত্তেজনা প্রশমন করতে সেই রাতেই হল থেকে বহিষ্কার করলেন। যুগপৎ বাংলাদেশ ছাত্রলীগও ওই মুহূর্তে সেই প্রবল প্রতাপান্বিত ছাত্রীনেত্রীকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। আর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তদ্দণ্ডেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখানেই ‘কুল্লু খালাস’ হলে কথা ছিল না। ওই নেত্রীর গলায় নাকি পাদুকামাল্য পরিয়ে দেয় এ যাবৎকাল তার কথিত অত্যাচারে জর্জরিত সাধারণ ছাত্রীরা।...জনরোষের বহিঃপ্রকাশ আর কাকে বলে! তবে অবশ্যই ব্যাপারটা নিন্দনীয়।

কিন্তু এটা ছিল সেই মেলোড্রামার দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য। দ্বিতীয় দৃশ্য মঞ্চায়িত হলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই। উত্তেজনায় রোমাঞ্চিত দর্শকবৃন্দ দেখতে পেল, রাত না পোহাতেই সেই ছাত্রীনেত্রীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে সংশ্লিষ্ট সবাই—ছাত্রলীগ, হল কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর সূর্যালোকিত সকালে গলায় একগাদা পুষ্পমাল্য ঝুলিয়ে নেত্রী ফিরে আসেন হলে (নাকি তার ক্ষণিকের জন্য হৃত সাম্রাজ্যে!)

এর পাশাপাশি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের তৎপরতার পরিচয় দিতে ‘কোটা’বিরোধী আন্দোলনের তিন নেতাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে, থুককি, ডি. বি. অফিসে নিয়ে গেল। অবশ্য পুলিশ চোখ বাঁধার ব্যাপারটি অস্বীকার করে; কিন্তু আটক ছাত্ররা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। পরে ছেলেগুলো তাদের মা-বাবার দোয়ায় দ্রুতই ছাড়া পায়।

আর বোধ হয় ওই দিন রাতেই কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ মহোদয়া (ভালো কথা। এই প্রাধ্যক্ষ এবং এই ধরনের কিছু কিছু শব্দ তাদের ইংরেজি প্রতিশব্দকে হটিয়ে কিছুকাল আগে থেকে বাংলা ভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু মুখের বুলিতে প্রাধ্যক্ষ নয়, প্রভোস্ট শব্দটিই চালু আছে। চেয়ার-টেবিলের বাংলা কেদারা-মেজ ইত্যাদি করলেও ওগুলোতে বসে বা ওগুলোর ওপরে রেখে লিখে আরামের দিক থেকে কোনো তারতম্য হয় না। আবার একই পরিমণ্ডলে প্রক্টর শব্দটির কিন্তু কোনো বাংলা করা হয়নি। (প্রক্টরের বাংলা কি দারোগা জাতীয় কিছু হবে নাকি?) তাঁর শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য গভীর রাতে হঠাৎই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি হলের চারজন আবাসিক ছাত্রীকে ওই দুর্যোগপূর্ণ রাতেই তাদের অভিভাবকদের ডেকে হল থেকে বের করে দিলেন। তাদের অপরাধ, তারা নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। জানি না, মাননীয়া প্রভোস্টের কেন মনে হলো সেদিনের সেই ঘটনাবহুল রাত আর কোনো দিন পোহাবে না, কিংবা ভোর হওয়ার আগে রাতের অন্ধকারে ওই ‘অপরাধী’ ছাত্রীরা তার লৌহকপাটের কয়েদখানা থেকে পালিয়ে যেতে পারে। রাত দুপুরে কোনো মেয়েকে হল থেকে বহিষ্কার করে সেই মুহূর্তেই তার স্থানীয় অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া—এটা কোন ধরনের দায়িত্ববোধ? এটা কি সম্পূর্ণ অমানবিক একটি আচরণ নয়? খোদা না খাস্তা, ওই মেয়েদের কেউ বা তাদের অভিভাবক যদি ওই রাতে পথে কোনো বিপদে পড়তেন, তাহলে তার দায়ভার কি প্রভোস্ট নিতেন? তার শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন সকাল পর্যন্ত স্থগিত রাখলে যুব মহিলা লীগের নেত্রী বলে কথিত ওই মাননীয় প্রভোস্টের চাকরি কি ‘নট্’ হয়ে যেত? প্রভোস্ট নয়, একজন শিক্ষকের কাছে, একজন মায়ের কাছে প্রশ্নগুলো রাখলাম। কেন ভেবে দেখেন না এমনও তো হতে পারত, আপনি ঢাকা নয়, রাজশাহী, দিনাজপুর বা খুলনায় কর্মরত ও আপনার মেয়ে ঢাকায় কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রী, আর সেই মেয়েকে এইভাবে রাত দুপুরে ঝড়-বাদলের মধ্যে এক বস্ত্রে বের করে দেওয়া হলো, তা হলে কী হতো? আপনি এটা মেনে নিতে পারতেন? দুশ্চিন্তায় কি আপনার মাতৃহৃদয় মথিত হতো না? মাননীয় প্রভোস্ট, বিবেকটাকে চাকরির লৌহসিন্দুকে আর রাজনীতির কটুগন্ধময় অন্ধগলিতে আটকিয়ে না রেখে একটু রাঁদা মেরে পয়ঃপরিষ্কার করুন, দেখবেন যে মেয়েকে আপনি অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দিলেন তার ও আপনার সুকন্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেদিন থেকে সেই মেয়ে আপনার হলে ঢুকেছে, সেদিন থেকে সে আপনার নিজের মেয়ের মত।

৩.

শিক্ষার্থীদের দাবি যে অযৌক্তিক নয়, তা সবাই স্বীকার করেন। এমনকি জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও তা মেনে নিয়েছেন। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, তাঁদেরও শঙ্কিত করে তুলেছে। তাঁরা মানববন্ধন ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন।

এই প্রেক্ষিতে আর কালক্ষেপণ না করে পুরো বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। ‘কোটা’সংক্রান্ত নীতিমালা সংস্কার করে এটাকে যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি। সব কিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের জাতীয় স্বার্থ। স্মরণ রাখতে হবে, এখন যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে, পুলিশের ধাওয়া খাচ্ছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে, যাদের জীবন হুমকি-ধমকি দিয়ে বিষময় করে তোলা হচ্ছে, তারাই দু’দিন পর উপাচার্য হবে, প্রাধ্যক্ষ হবে। শ্রদ্ধেয় স্যাররা/ম্যাডামরা, এখন তাদের যাত্রাপথকে কণ্টকাকীর্ণ না করে, জেদের বশবর্তী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অহেতুক ‘অ্যাকশনে’ না গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। বলুন, বাবা, আমরা তোমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, আমরা তোমাদের প্রতিপক্ষ নই। তোমরা আমাদের সন্তানতুল্য। মা-বাবা কি কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করতে পারে? আপনারা আপনাদের সব সৎ প্রচেষ্টা তাদের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করুন। দেখবেন শিক্ষাঙ্গন কত সুন্দর, কত পূতপবিত্র হয়ে উঠেছে।

আর আমরা অভিভাবকরাও আমাদের সন্তানদের শিক্ষাঙ্গনে, ছাত্রনিবাস-ছাত্রীনিবাসে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। আমরা কেন ভুলে যাই—বায়ান্নতে, বাষট্টিতে, ঊনসত্তরে যারা আন্দোলন করেছিল, তারাও ছিল এ দেশেরই সন্তান। সেদিন তাদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে আপনার-আমার মত অভিভাবকরা একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সন্তানের পাশে মা-বাবা দাঁড়াবে না, এ কথা মনে করা ভুল। সে জন্যই তো ‘কোটা’ আন্দোলনকারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে পিতামাতারা আছেন তাঁদের সন্তানের পাশে। তাঁরা থাকবেন না তো কে থাকবে, বলুন?

ভুলে যাবেন না, আপনি-আমি সরকারে-বেসরকারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রশাসনে, পুলিশে—যেখানেই থাকি না কেন, এই তরুণরা আপনার-আমার সন্তান। সেই সন্তানকে একটু সময় দিন, সে কী বলতে চায় শুনুন। শুধু রক্তচক্ষু আর প্রশাসনের জুজুর ভয় দেখিয়ে তাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জীবনটা বিভীষিকাময় করে তুলবেন না।

শেষ করব আমার প্রিয় একটি অণুকবিতার চরণ উদ্ধৃত করে : যৌবন বসন্তসম সুখময় বটে/দিনে দিনে উভয়ের পরিণাম ঘটে।/কিন্তু পুনঃবসন্তের হয় আগমন/ফিরে না ফিরে না আর ফিরে না যৌবন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

 

লেখক : মোফাজ্জল করিম,সাবেক সচিব, কবি।

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038149356842041