মাদরাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতন : মন্ত্রণালয়-মিডিয়া-মানবাধিকার সংগঠন কোথায়? - দৈনিকশিক্ষা

মাদরাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতন : মন্ত্রণালয়-মিডিয়া-মানবাধিকার সংগঠন কোথায়?

নিজস্ব প্রতিবেদক |

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি মাদরাসার আবাসিক ছাত্রকে (৮) জন্মদিনে গত মঙ্গলবার দেখতে গিয়েছিলেন তার মা। বিদায়ের সময় শিশুটি মায়ের পেছন পেছন যেতে শুরু করে। এই ঘটনাকে অপরাধ ধরে নিয়ে তাকে তার মাদরাসার শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া প্রথমে ঘাড় ধরে মাদরাসার ভেতর নিয়ে যান। তারপর পা ধরে সারা শরীরে বেত দিয়ে বেদম প্রহার করেন। আট বছরের শিক্ষার্থীকে প্রহারের ৩৩ সেকেন্ডের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় ওঠে।

দেশের মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের খবর সারা বছরই কমবেশি প্রকাশ হচ্ছে। মাদরাাসায় কন্যা ও পুরুষ শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর ওপর ধর্ষণ ও বলাৎকার নিয়ে সরকার মহলে আলোচনা নেই। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ যেসব এনজিও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি ডলার আনে ও গণ মাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে থাকেন তারাও নীরব। গণমাধ্যমগুলোতেও তেমন গুরুত্ব পায় না এসব ঘটনা। এমনকি দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনেও এই নির্যাতনের পরিসংখ্যান থাকে না। যদিও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সরকার ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে। দেশের মাদরাসা নিয়ে বহুদিন ধরে নির্যাতনের খবর প্রকাশ হলেও সরকার এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেয়নি।

বার্তা সংস্থা এপি’র ঢাকা ‍ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম নিজ ফেসবুকে আক্ষেপ করে লিখেছেন, "বাচ্চাটাকে অমন করে পেটালেও কারও কিচ্ছু যায় আসেনা, মিডিয়ারও না। কারণ বাচ্চাটা সমাজের তলায় যে স্তর সে স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে, মধ্যবিত্ত স্তরে হলে অন্তত হৈ হৈ রৈ রৈ হতো চারদিকে। অথচ প্রাইম টাইম নিউজে প্রধান শিরোনাম হবার কথা, টক শোতে ঝড় ওঠার কথা, কারা ব্যর্থ, কেন ব্যর্থ, দায়িত্বে থাকা দপ্তর বা সিস্টেমের কোথায় গলদ, সেই চিত্র উঠে আসার কথা। সমাজের এমন নেতিবাচক  চিত্র তুলে ধরার এবং তা শোধরানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের গভীর প্রয়োজনীয়তাকে মূল এজেন্ডায় নিয়ে আসার তাগিদ আমাদের নেই। বস্তা পঁচা বুলি আমাদের কাছে আরাধ্য। প্রিয় মিডিয়াকে বলছি।" 

দেশে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী মাদরাসায় শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তার তথ্য নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা তা প্রকাশ করে না। বেশ কয়েকজন সাবেক ছেলে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, তাদের ওপর যৌন নির্যাতন ঘটেছে। কিন্তু লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তখন এ বিষয়ে মুখ খোলা যায়নি।

এক মাসে ৪০ শিক্ষার্থী বলাৎকার, শিক্ষার এনজিও-মানবাধিকার সংগঠনগুলো চুপ : গত বছরের নভেম্বর মাসে দেশের কওমি মাদরাাসায় ৪০ ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। তারা বলছে, এসব ঘটনায় কেবল মামলা হয়েছে, চেপে যাওয়া ঘটনা আরও বেশি।

গত বছরের ৪ মার্চ ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ময়মনসিংহের ভালুকার জামিরদিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী তাওহিদুল ইসলাম (১০)। তাওহিদুলের পড়া মুখস্থ না হওয়ার অপরাধে ওই মাদরাসার শিক্ষক আমিনুল ইসলাম ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পাঁজরের একটি হাড় ও একটি পা ভেঙে দেন। তাওহিদুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, মাদরাসাগুলোতে যৌন নির্যাতন করা হয় শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগ প্রায়ই উঠছে। পুরুষ ও কন্যাশিশু উভয়ের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায় গণমাধ্যমে। তবে ভুক্তভোগী কয়েকজন সাবেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলছেন, যত শিক্ষার্থী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তার সামান্য তথ্যই বাইরে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক বা যৌন নির্যাতন কোনোটির তথ্য প্রকাশ হয় না।

গত বছরের ১৮ অক্টোবর জয়পুরহাট সদর উপজেলার মুজাহিদপুর নুরানী মাদরাসার শিক্ষক আব্দুর রশিদকে চার শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিশুদের অভিভাবক বাদী হয়ে জয়পুরহাট সদর থানায় শিশু নির্যাতন দমন আইনে আব্দুর রশিদকে আসামি করে মামলা করেন।

গত ২৫ জানুয়ারি অধিকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মোট ১ হাজার ৫৩৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৭৭ জন নারী, ৯১৯ জন মেয়েশিশু এবং ৪২ জনের বয়স জানা যায়নি। গত বছর ২৮১ জন নারী ও মেয়েশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দৈনিক পত্রিকার বরাত দিয়ে জানানো হয়। এসব নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের সঙ্গে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। ধর্ষণের বিচার না হওয়ার পেছনে পুলিশের ভূমিকাকে প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়। তবে এই প্রতিবেদনে মাদরাসায় ছেলে ও নারী শিশুর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কোনো তথ্য নেই।

দেশের আরেক মানবাধিকার সংগঠন আসক গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর দেশের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক নির্যাতনসহ নারীর (কন্যাশিশুসহ) ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলেও দেশের মাদরাসায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তা নেই।

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন বলেন, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বলাৎকার, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়, এটি ফৌজদারি অপরাধ। সাম্প্রতিককালে মাদরাসায় যা ঘটছে, সেটি সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। দেশের প্রচলিত আইনে এসব ঘটনার বিচার হতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, মাদরাসায় ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনার তথ্য বাইরে খুব কম আসে। আর যেসব তথ্য বাইরে আসে তা নিয়ে সবার মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নৈতিক স্খলনকে যেভাবে আমরা দেখি ও ঘটনার বিচার চাই, মাদরাসার শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদরাসার শিক্ষকরা কোনোভাবেই বিশেষ সুবিধা যেন না পান, সেটি দেখতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন হলে তা কড়া হাতে দমন করতে হবে সরকারকেই।

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029809474945068