মাধ্যমিকে কর্মমুখী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা কি জরুরি? - দৈনিকশিক্ষা

মাধ্যমিকে কর্মমুখী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা কি জরুরি?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ২০২১ সালে স্কুল ও মাদ্রাসায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। এ বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১, ২, ও ৩ নামে তিনটি বই প্রণয়নের জন্য সিলেবাস তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

 বই সম্পাদনার কাজ চলছে। এ ছাড়া নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় কারিগরি শিক্ষার বই বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করা হয়। সংসদীয় কমিটি তাদের এক বৈঠকে সাধারণ শিক্ষায় কর্মমুখী শিক্ষা চালুর সুপারিশ করেছিল।  মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন ড. মো. ইকবাল হোসেন।

আমাদের মূলধারার সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো শাখা বিভাজন নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি-১০ অনুযায়ী কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে পারে। নতুন কাঠামোতে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক স্তর। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বিভাজন আসবে না। সবার জন্য পাঠ্যক্রম একই থাকবে। প্রণীত কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা-১, ২, ও ৩ বই তিনটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে। এটা আদৌ কোনো সুফল দেবে কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিষয়ই হল প্রকৌশল শিক্ষার ভিত্তি।

এমনকি প্রকৌশলের øাতক পর্যায়ের উচ্চশিক্ষার প্রথম দিকে মৌলিক বিজ্ঞান পাঠদান করা হয়। সঙ্গে থাকে বাণিজ্য ও মানবিকের কিছু বিষয়। প্রকৌশল একটি উচ্চতর যৌগিক শাস্ত্র। সুতরাং এটিকে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বোধগম্য করাটাও একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বরং প্রকৌশল শিক্ষার কিছু ধারণা বিদ্যমান বিজ্ঞান বিষয়গুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো সহজ হতো। অপরদিকে, নবম ও দশম শ্রেণিতে সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রকৌশল শিক্ষা বিভিন্নভাবে জটিলতা সৃষ্টি করবে বলে আমি মনে করি। কারণ এ পর্যায়ে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা ইতিমধ্যেই রয়েছে। বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদপত্র প্রদানের জন্য ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘ইস্ট পাকিস্তান বোর্ড অব এক্সামিনেশন ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন’ নামে একটি বোর্ড স্থাপিত হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশের কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সংগঠন পরিচালন, তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব পালন, পরীক্ষা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও বোর্ড কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের ডিপ্লোমা/সার্টিফিকেট প্রদান (সূত্র : শিক্ষা মন্ত্রণালয়)।

অতঃপর ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ট্রেড পর্যায়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ, সনদপত্র প্রদান, পরিদর্শন ও মূল্যায়নের জন্য একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ফলে ১৯৬৭ সালের ৭ মার্চ গেজেট নং-১৭৫ এলএ প্রকাশিত এবং ১নং সংসদীয় আইনের বলে ‘ইস্ট পাকিস্তান টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (সূত্র : শিক্ষা মন্ত্রণালয়)।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন স্বল্পমেয়াদি এবং মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিপ্লোমা পর্যায়ে নানা বিষয়ে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ ইতিমধ্যেই রয়েছে। এ বোর্ডের শিক্ষার্থীদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কারিগরি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথও উন্মুক্ত রয়েছে। তবে এর জন্য তাদের পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পরিতাপের বিষয়, বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাটিকে এখনও পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।

আমরা পারিনি, এটাকে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো এক বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে, সামাজিকভাবে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিতে। অথচ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত দেশগুলোর অনেক মেধাবী এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। চীন ও জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা যায়। গত বছর জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বহুদেশীয় একটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে খ্যাতিসম্পন্ন একটি জার্মান রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করি।

একজন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়া যথার্থভাবে উপস্থাপন করলেন। কথায় কথায় জানালেন তিনি একজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আদান-প্রদান করলেন একজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। ভাবুন সে দেশে কারিগরি শিক্ষার মানের কী অবস্থা! মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চশিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল এবং এটা সবার জন্য নয়। বিশ্বের সব দেশেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত।

আবার শিক্ষায় দীর্ঘ সময় থাকা সবার জন্য সম্ভবও নয়। কাজেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা-প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মানজনক ক্যারিয়ার গড়া অবশ্যই সম্ভব। এটা মেধাবীদের জন্যও হতে পারে একটি বিকল্প। নীতিনির্ধারকদের উচিত আমাদের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি নজর দেয়া। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ গুণগতমান বৃদ্ধি নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পক্ষান্তরে, এখন ঘটছে ঠিক উল্টোটি। মাধ্যমিকে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, কিন্তু কেন? বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। কারিগরি জ্ঞান সবার থাকা চাই। নীতিনির্ধারকরা হয়তো এই দর্শনে কাজ করছে। শিক্ষা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আর গুরুত্বহীনতার ছাপ সুস্পষ্ট, সেই শুরু থেকেই। একটি উদাহরণ দেয়া যাক।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে এ দেশে প্রথমে শিক্ষাকে ধর্ম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতের সঙ্গে মিলিয়ে একটি মন্ত্রণালয় করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়। তারপর ১৯৮৪ মার্চে তা পরিবর্তন করে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় করা হয়। অবশেষে ১৯৯৩ সালের আগস্টে শিক্ষা খাতকে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে পাই।

অর্থাৎ শিক্ষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে পেতে আমাদের ২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা আর গুরুত্বহীনতার প্রমাণে আর কী চাই। শিক্ষা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের আরও পরিকল্পিত হতে হবে। পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন- সবকিছুই জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়কেই পরিকল্পিত হতে হবে। সময় নিয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলে, বা মাধ্যমিক শেষে শিক্ষা সমাপ্তির সম্ভাবনা ও প্রয়োজন থাকলে, তাদের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন যাওয়াই শ্রেয়। এতে করে অল্প সময়ে প্রাপ্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সনদ দিয়েই একটি ক্যারিয়ার শুরু করা যাবে। মানবিক ও বাণিজ্য বিষয়ের উচ্চশিক্ষার্থীরাও প্রয়োজনে নিজেরাই কারিগরি বিষয়ের সাধারণ শিক্ষা আলাদা করে শিখে নিতে পারে।

সুতরাং মূলধারার মাধ্যমিকে কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এ মুহূর্তে জরুরি কিছু নয়। কারণ শিক্ষা নিয়ে অনেক কিছু করা এখনও আমাদের বাকি। প্রয়োজন বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা, কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নেয়া। বিদ্যমান মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন। প্রয়োজন প্রকৌশল ও প্রযুক্তিসহ এ দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিক শিক্ষা উপকরণের প্রয়োগ, উচ্চশিক্ষা খাতে গবেষণা বরাদ্দ।

ড. মো. ইকবাল হোসেন : শিক্ষক, কেমিকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075538158416748