মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতেই হবে - দৈনিকশিক্ষা

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতেই হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির, স্বল্প আয়তনের, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতার দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত, সে দুটি খাতের একটিও এবারের বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।

উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল খাত : সরকারি অর্থের বরাদ্দ ও খরচ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় খাতেই হতে পারে। উৎপাদনশীল খাত বলতে যেসব আর্থিক খাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ ও সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলোকে বোঝায়। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি। অনুৎপাদনশীল খাতের মধ্যে পড়ে জনপ্রশাসন (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান), প্রতিরক্ষা, বিনোদন, ক্রীড়া প্রভৃতি। সোমবার (১৮ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, কিছু উৎপাদনশীল খাত এমনও আছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেগুলোর অবদান সরাসরি চোখে পড়ে না; কারণ সেসব খাতের থাকে বেশ দীর্ঘ সুপ্তিকাল (Gestation Period)। শিশু-কিশোরদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ১৫-২০ বছর ধরে চলে, এ সময়ে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু উৎপাদন করে না। কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণ মানবসম্পদের উন্নয়ন করে প্রায় সরাসরি, এর সুপ্তিকাল একেবারে কম হওয়ায় উন্নয়ন সহজে চোখে পড়ে এবং এসব প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ খুব তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাস্থ্যবান মানুষ কর্মী হিসাবে স্বাস্থ্যহীন বা রোগা কর্মীদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বলে স্বাস্থ্য খাতের খরচকে শিক্ষা খাতের চেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানকারী হিসাবে দেখা যায়।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খাতের সুপ্তিকাল দীর্ঘ হলেও দেশের উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী অবদান থাকে। এসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বর্ধিত আয়ের যোগ্যতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাড়তি প্রভাব ফেলে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ আসলে বিনিয়োগ : অর্ধশতাব্দী আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্যাপিটাল স্কুল শিক্ষা খাতের খরচকে বিনিয়োগ বলে প্রমাণ করে রেখেছে (Schultz, 1961)। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তঃসত্ত্বা প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব (Endogenous Growth Theory, Romer 1990) অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে ভেতর থেকে; এর অবদান বাহ্যিক মডেলের বিশ্লেষণে সরাসরি ধরা পড়ে না।

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ : জাতিসংঘের শিশু তহবিল দীর্ঘদিন শিক্ষা খাতে জিডিপির সাত শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছিল। তবে সংস্থাটি ২০১৫ সালের ইঞ্চিয়ন ঘোষণায় (Incheon Declaration 2015) এই খাতে জিডিপির ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে। এর কম বরাদ্দে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ (শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য) অর্জন করা যাবে বলে মনে হয় না।

শিক্ষা খাতে উন্নত বিশ্বের আর্থিক বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে আমরা এশিয়ার কিছু নিকট প্রতিবেশীর দিকে তাকাই। ভুটান এই খাতে জিডিপির ৭.২ শতাংশ বিনিয়োগ করে। ভারত ও পাকিস্তানের এ খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮ ও ২.৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রায় প্রতিবছর শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ করে থাকে। করোনার আঘাতে দুবছরের বেশি সময় বিদ্যালয় প্রায় বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি পূরণ করার জন্য এবং ‘নতুন’ নামে খ্যাত পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য এবার অন্য বছরের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দরকার ছিল। অথচ এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ভাগ কমে হয়েছে জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ! 

বাজেট বরাদ্দকে মন্ত্রণালয়ের কোণ থেকে (দৃষ্টিতে) দেখা যাক। বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪০টির মতো। প্রতি মন্ত্রণালয় ভাগে পাওয়ার কথা জিডিপির ২.৫ শতাংশ। সে হিসাবে দুটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাগ দাঁড়ায় জিডিপির ৫ শতাংশ, যা জাতিসংঘ শিশু তহবিল-নির্ধারিত ৪-৬ শতাংশের মাঝখানে পড়ে। শিক্ষা খাত এ যৌক্তিক ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন?

দেশে স্বাস্থ্য খাত এখনো অবহেলিত : মানবসম্পদ উন্নয়নের বিচারে স্বাস্থ্য শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারণ স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে শিক্ষাগ্রহণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। আমি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে অবস্থিত সেন্ট নিকোলাস হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ১৯৭৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ইংরেজির শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস একটু পেট খারাপ হলেই স্কুলে আসতেন না। আমাদেরও অসুস্থ অবস্থায় স্কুলে যেতে বারণ করতেন। তার যুক্তি ছিল : শরীর সুস্থ না থাকলে শিক্ষার মতো উন্নত মানসিক কাজ ভালো হতে পারে না। শিক্ষা গ্রহণের মতো কাজ দায়সারা গোছের করে তো করা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫.২৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এ হিসাব দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দেশটির পরে, অল্পের জন্য নিচের দিক থেকে প্রথম হওয়ার ‘গৌরব’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি! স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের সংখ্যার চেয়ে সেবিকার সংখ্যা বেশি হতে হয়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন সেবিকা থাকেন। বাংলাদেশে এই হার উলটো; ২.৫ জন চিকিৎসকের জন্য আছেন মাত্র একজন সেবিকা। এর কারণ কি এই যে, আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেবিকা তৈরির জন্য যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা নেই? না থাকলে কোত্থেকে আমরা মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাই ঘরকন্নার কাজ করার নামে নানাভাবে নিগৃহীত হতে?

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত গত বছর স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২.১ শতাংশ খরচ করেছে; ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এ খাতে ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে। আমাদের একক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো হিসাবে জিডিপির ২.৫ শতাংশ ভাগে পায়। সেখানে এ করোনা-পীড়িত দেশে কী করে জিডিপির মাত্র ০.৮২% বরাদ্দ দেওয়া হয়? শোনা যায়, গত বছর এ মন্ত্রণালয় জডিপির ১ শতাংশের কম বরাদ্দের অর্থই ব্যয় করতে পারেনি! প্রশ্ন আসে, যারা স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের অর্থ বোঝেন না, তারা এ খাতের মন্ত্রী-সচিব হন কী করে?

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুই দশক আগে আবিষ্কার করলেন-গণতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমরা যা-ই ভাবি না কেন, আমাদের বহু নেতা দিবানিশি দেশে উন্নয়নের ঢোলক বাজিয়েই চলেছেন। তাহলে দুর্ভিক্ষ কেন? না, আমাদের এ স্বাধীন দেশে খাদ্য নিয়ে দুর্ভিক্ষ একবারই হয়েছিল ১৯৭৪-’৭৫ সালে। মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে উদাসীন থাকা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্য আর্থিক বরাদ্দের অর্ধেকও না দেওয়া থেকে মনে হয় আমাদের মন্ত্রিপরিষদের অধিকাংশ সদস্যের মধ্যেই চলছে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় আছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। আর আগের দিনের মতো আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, বিজ্ঞানীরা এখন কার্যকর (ক্ষমতাসীন) রাজনীতিতে নেই। আশা করি, আমাদের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের দায়িত্ব ভালোভাবে বুঝে মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারণা কাজে লাগিয়ে সংসদে পাশ হয়ে যাওয়া বাজেট পুনরায় পর্যালোচনা করে শিক্ষা খাতে অন্তত ৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে অন্তত ১.৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবেন এবং বাজেটে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি (যৌক্তিক ও জনকল্যাণকর) খরচের অনুমোদনও দেবেন।

লেখক : ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা, শিক্ষা গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003277063369751