বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আজ মঙ্গলবার আদালতে দাখিলের দিন ধার্য ছিল, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগেই রবিবার তড়িঘড়ি করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়ে দেয় পুলিশ। গোপনীয়তা বজায় রেখে শেষ বিকেলে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
হাইকোর্ট মিন্নির জামিন মঞ্জুর করার ঠিক দুই দিন পরই মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করে দেয় পুলিশ। কেন এই তড়িঘড়ি ও অতিগোপনীয়তা? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, উচ্চ আদালতে মিন্নির জামিনের রায়ের কপি রবিবার বের হয়। একই দিন বিকেলে জামিনের আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
গতকাল সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত মিন্নির জামিনের আদেশ বহাল রেখেছেন। মূলত মিন্নির জামিন রুখতে তড়িঘড়ি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছে। এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রিফাত হত্যার দুই মাস চার দিন পর রবিবার বরগুনা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চার্জশিট দাখিল করার পরে এ-সংক্রান্ত ছোট একটি প্রেস নোট সাংবাদিকদের সরবরাহ করা হয়। পরে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে আর কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি তদন্ত কর্মকর্তা। জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা চার্জশিটসংক্রান্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।
এদিকে চার্জশিট দাখিলের পরপরই বরগুনার এসপিকে নিয়ে অনেক প্রশংসামূলক পোস্ট দেখা যায় ফেসবুকে। গতকাল সকাল থেকে বরগুনার প্রায় সব থানার অফিশিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, বিভিন্ন পর্যায়ের বরগুনা জেলায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রফাইল থেকে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনকে সৎ, নির্ভীক, সাহসীসহ নানা প্রশংসামূলক বিশেষণে বিশেষায়িত করে রিফাত হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করার জন্য অভিনন্দন জানানো হয়।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একের পর এক নাটকীয়তায় তদন্ত চলতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা ছিল এই মামলার প্রধান সাক্ষী, নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার। ২৭ জুন বরগুনা থানায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফের দায়ের করা মামলায় আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি প্রধান সাক্ষী ছিলেন। আদালতে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে মিন্নিকে ৭ নম্বর আসামি দেখানো হয়েছে। ফলে এ মামলায় এখন প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষী নেই। যদিও পুলিশ শুরু থেকেই বলে আসছে, সংগত কারণেই এ মামলায় সাক্ষী থেকে এখন আসামি হয়েছেন মিন্নি। তবে মিন্নিকে ঘিরে পুলিশের অতি উৎসাহী মনোভাব ও কার্যক্রমকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ভাবছে সংশ্লিষ্ট অনেকে।
মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারি আসলাম বলেন, ‘শুরু থেকে পুলিশের তদন্ত যে প্রক্রিয়ায় এগিয়েছিল, আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। এই মামলার বাদীকে ভিকটিম রিফাত শরীফ মৃত্যুর আগে জবানবন্দিতে মিন্নিকে সাক্ষী করতে বলেছেন বলে আমরা জেনেছি। সেভাবেই মামলাটি দায়ের করা হয়।
কিন্তু হঠাৎ করেই মাঝপথে নাটকীয় মোড় নিয়ে এখন যে পর্যায়ে এসে চার্জশিট হয়েছে, এটা সত্যি দুঃখজনক। উচ্চ আদালত মিন্নিকে জামিন দেওয়া এবং জামিনের আদেশ পরবর্তী চার পৃষ্ঠার রায়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য ও নির্দেশনার পরপরই হঠাৎ এ চার্জশিট দাখিল আমাদের অবাক করেছে। মূলত জামিন বাতিলে আপিলের গ্রাউন্ড তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য ছিল।’
তিনি বলেন, মিন্নির জামিন আদেশের রায় গতকাল বের হয়েছে। সেটি আজ মঙ্গলবার বরগুনার আদালতে পৌঁছতে পারে। এর ফলে আজকেই মিন্নি জামিনে মুক্তি পেতে পারেন।
বরগুনা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, “শুরু থেকেই ‘তদন্তের স্বার্থে’র দোহাই দিয়ে কোনো আসামিরই গ্রেপ্তারের স্থান ও সময় উল্লেখ করেনি পুলিশ। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিশেষ মহল অপপ্রচার চালিয়ে মিন্নির চরিত্র হননের চেষ্টা করল। মিন্নিকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে ১৩ ঘণ্টা পুলিশ লাইনসে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো।
এরপর আদালতে আইনজীবী না পাওয়া এবং রিমান্ডকালীন মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে পুলিশের আগাম মন্তব্য—এসব কিছুকেই আমরা মনে করি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঠিক একই প্রক্রিয়ার আপিলে জামিন বাতিলের গ্রাউন্ড তৈরি করতেই তড়িঘড়ি করে অতিগোপনীয়তায় পুলিশ এই চার্জশিট দাখিল করেছে বলে আমার মনে হয়। এই ধরনের ঘটনার পর মনে হচ্ছে মামলাটি রাষ্ট্র বনাম মিন্নি।’
জাতীয় মহিলা সংস্থা, বরগুনা জেলার চেয়ারম্যান হোসনে আরা চম্পা বলেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে একজন নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। রিফাত হত্যা মামলায়ও আমরা সবাই ন্যায়বিচারের দাবি রাখি, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিন্নিকে ঘিরে পুলিশের যে ভূমিকা এটা আমাদের সবার মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মিন্নি ঘটনায় জড়িত থাকলে অবশ্যই সে বিচারের আওতায় আসবে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কারো ওপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া অপচেষ্টার শামিল। মিন্নি নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার দাবি করতে পারে এবং নারীর জন্য মানবাধিকারের সুবিধাও সে পাবে।’
গত ২৬ জুন জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। এ নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার মধ্যে ২ জুলাই এ হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। রিফাতের ওপর হামলার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তাঁর স্ত্রী মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় মিন্নিকে ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়। এরপর পুলিশের সিসিটিভি ফুটেজ কেটেছেঁটে গণমাধ্যমে প্রকাশের পর একটি পক্ষ মিন্নির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে। মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। এরপর ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে সেদিন রাতে তাঁকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পরের দিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। কিন্তু মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী সেদিন আদালতে দাঁড়াননি, যা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণী হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন মিন্নি।
তবে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের অভিযোগ, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তাঁর দাবি।
এদিকে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার শর্তে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করেন। জামিনের ওই রায় স্থগিতের জন্য রবিবার আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। মিন্নির জামিন স্থগিতের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ যে আবেদন করেছিল, তা শুনে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর চেম্বার আদালত সোমবার ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন।
আর এর ফলে কলেজছাত্রী মিন্নির জামিন বহাল থাকছে এবং তাঁর মুক্তিতে কোনো বাধা থাকছে না বলে তাঁর আইনজীবী জেড আই খান পান্না জানিয়েছেন।