মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি এবং আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ ও মানবিক সুবিবেচিত আচরণের সমষ্টিগত রূপই হলো মূল্যবোধ। মূল্যবোধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটি বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক ধারণা হলো সুশাসন। সুশাসন প্রসঙ্গে ম্যাককরনি বলেছেন, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে শাসিত সমাজের, শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ক বোঝায়।’ অর্থাত্, এ তিনটির মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ক কেমন হবে, সেটার রূপরেখা চিত্রায়ণ করে সুশাসন। সুশাসনের পূর্বশর্ত গণতন্ত্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সুশাসনের কথা চিন্তা করা যায় না। আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ কল্যাণমুখী। রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে সদা সর্বোচ্চ চেষ্টাসহ তত্পর থাকাই কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। নিজেদের রাষ্ট্রকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র এবং সরকারকে সুশাসনের সরকার বলে দাবি করা রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগ দেশেই তা কেবল কাগজে-কলমেই প্রতীয়মান, বাস্তবে নেই এর প্রতিফলন। সুশাসন সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে শাসক ও শাসিতের সুসম্পর্ক, সর্বোচ্চ স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন, নীতির গণতন্ত্রায়ণ, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ, পছন্দ ও মতামত প্রদানের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধের চর্চা। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের বিকল্প নেই। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে মূল্যবোধ অনুপস্থিত, সেখানে সুশাসন কখনোই প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশেও মূল্যবোধ ও সুশাসনের অভাববোধ লক্ষণীয়। চারপাশে অপরাধ ও অপরাধীর ছড়াছড়ি। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতেও দৃশ্যমান। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার মতো জঘন্যতম ঘটনাটি গোটা জাতিকে বাক্রুদ্ধ করে দিয়েছে। বুয়েট ছাড়াও দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থাও শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররা কেবল বইয়ের পর বই পড়ে শিক্ষাকে মুখস্থ বিদ্যায় পরিণত করে মগজ ভারী করছে। শিক্ষাকে ধারণ করছে না অন্তরে, ঘটছে না তাদের মন ও আত্মার পরিপূর্ণ সুষম বিকাশ, হচ্ছে না সুশিক্ষিত। যেখানে শিক্ষার চরম ও পরম লক্ষ্য মানবজীবনের সব দিকের উত্কর্ষ সাধনের মাধ্যমে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলা, সেখানে ছাত্ররা শিক্ষাকে কেবল কর্মোপযোগী জ্ঞান ও কলাকৌশল অর্জনের প্রক্রিয়া হিসেবেই বিবেচনা করছে। সে জন্যই তাদের মধ্যে ঠাঁই করে নিতে পারছে না মূল্যবোধের শিক্ষা। মূল্যবোধকে সুদৃঢ় করার নিয়ামকই হলো শিক্ষা।
শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের প্রতিটি স্তরে স্তরে বাসা বেঁধেছে মূল্যবোধহীন নৈতিকতা-বিবর্জিত মানসিকতা। তাদের মানুষের আদলে গড়া অবয়বের ভেতরে নেচে বেড়াচ্ছে ঘৃণ্য পশুত্ব। সুযোগ পেলেই থাবা বসাচ্ছে অসহায় নিরীহ মানুষের ওপর, সমাজব্যবস্থাকে ফেলছে হুমকির মুখে।
মূল্যবোধের চর্চাকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সুশাসন। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে আইনের শাসন? আইনের শাসনের মূল কথা হলো আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান; সবারই আইনের প্রশ্রয় লাভের সুযোগ; শুনানি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসবাস দুর্নীতির। বিশ্বের যে কোনো দেশের সুশাসনের পূর্বশর্ত সরকারি অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে দুর্নীতি কমানো। তাই সরকার ও জনগণের সম্মিলিত সহযোগিতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সরকার কর্তৃক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। জনসচেতনতা একদিকে যেমন নাগরিক অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ, অন্যদিকে সুশাসনের চাবিকাঠিও বটে। এছাড়া জনগণকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা ও উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি জনগণের ভূমিকাও অপরিহার্য। উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে স্বধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে উত্সাহী হয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
একটি শিশুর প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হলো তার পরিবার। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কর্তব্য শিশুর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা তথা মূল্যবোধের বীজ বুনে দেওয়া।
আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। যে বাংলাদেশের বুকে আবরারের মতো অসংখ্য আবরার কোনো নির্মমতার বলি হবে না। তারা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়ে এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সুশাসন ও গণতন্ত্রের দেশ তথা একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে সুপরিচিত করে তুলবে।
সুমনা মৃধা : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।