'মেধা বনাম কোটা' এবং কিছু বিভ্রান্তি - Dainikshiksha

'মেধা বনাম কোটা' এবং কিছু বিভ্রান্তি

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক |

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের যে চিন্তা-ভাবনা, তা তারা প্রতিবাদ আন্দোলনে প্রকাশ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে তার ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ উপস্থাপিত হচ্ছে। তাদের আন্দোলন থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা চাওয়া হচ্ছিল। গত ১১ এপ্রিল তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন- 'কোটা নিয়ে যখন এত কিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটারই দরকার নেই। কোটা থাকলেই সংস্কারের প্রশ্ন আসবে। এখন সংস্কার করলে আগামীতে আরেক দল আবারও সংস্কারের কথা বলবে। কোটা ব্যবস্থা বাদ, এটাই আমার পরিস্কার কথা।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্টভাবে সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা রহিতকরণের নির্দেশনা এবং একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী এই দিকনির্দেশনার মাধ্যমে কোটা সংস্কার নিয়ে উদ্ভূত জটিলতা নিরসনে সুদূরপ্রসারী ও সম্মুখদর্শী বা 'ফরওয়ার্ডলুকিং' সমাধান দিয়েছেন।

মনে রাখতে হবে, একবিংশ শতাব্দীর এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের টিকে থাকতে হলে তরুণদের মেধাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা ও মেধার যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত দিকনির্দেশনা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিগগিরই দেশবাসীকে অবহিত করা হবে। তরুণ আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেই অপেক্ষায় আছে।

এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, প্রতিটি দেশ ও সমাজে কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। একটি সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রজন্মকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের ওপর বর্তায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গড়ার কাজে যখন আত্মনিয়োগ করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের কঠিন কাজে যখন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখনই তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীর নানা কারণে পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা প্রবর্তন করেন। বিগত ৪৭ বছর ধরে নানা পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এখন কোটা ব্যবস্থা যে জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রজাতন্ত্রের চাকরির প্রায় ৫৬ শতাংশ কোটাভুক্ত থাকছে। আর বাকি ৪৪ শতাংশ মেধার জন্য উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কারণে ৫৬ শতাংশ চাকরি কোটাভুক্ত রাখা হয়েছে, তার পেছনে প্রজাতন্ত্রের কল্যাণমুখী চিন্তা-ভাবনা কাজ করেছে। কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এই লক্ষ্য অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে। অনগ্রসর তরুণ সমাজকেও খুব বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কারণ কোটাপ্রথার প্রয়োগ যেভাবে করা হয়েছে, তাতে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা খুব বেশি এগিয়ে আসতে পারেনি।

বিসিএস পরীক্ষার বিষয় যদি আমরা বিবেচনায় নিই, দেখা যাবে প্রায় আড়াই-তিন লাখ প্রার্থী বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করে থাকে। এই প্রার্থীদের সবাইকে সমভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে বাছাই প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হয়। 'প্রিলিমিনারি' পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকা প্রণীত হয়। এই পর্যায় পর্যন্ত কোটার কোনো সুবিধা প্রদান করা হয় না। আড়াই-তিন লাখ প্রার্থীর মাঝ থেকে চূড়ান্ত তালিকায় যদি ধরি সেই পাঁচ হাজার প্রার্থী স্থান পেয়েছে। এই স্থানপ্রাপ্ত পাঁচ হাজারের মাঝে কোটাপ্রথা পূরণ করে চাকরির জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।

আড়াই লাখ প্রার্থীর মাঝ থেকে একই প্রক্রিয়ায়, একই প্রশ্নপত্রে চূড়ান্তভাবে বাছাইকৃত পাঁচ হাজার প্রার্থী সত্যিই যে মেধাবী এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোটা প্রথার ৫৬ শতাংশ বিবেচনার জন্য পাঁচ হাজার প্রার্থী থেকে ৫৬ শতাংশ খুঁজে পাওয়া যায় না। সে কারণে প্রতিবারই কোটা অপূর্ণ থেকে যায়। আমাদের মনে আছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অপূর্ণ কোটায় মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন আরও কয়েক বছর আগে। বলা বাহুল্য, সেটাই যৌক্তিক ছিল এবং সেভাবেই বিগত কয়েক বছরে অপূর্ণ কোটা পূরণ হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এতদিন যেভাবে কোটা সংরক্ষণ এবং যে প্রক্রিয়ায় তা পূরণ করা হতো, তাতে করে যাদের স্বার্থে কোটা প্রবর্তিত হয়েছে, তারা কি উপকৃত হচ্ছে? বস্তুত কোটা ও মেধা নিয়ে বরং একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল নিছক বিভ্রান্তি থেকে। এই সমীকরণ যথার্থ তথ্যভিত্তিক ছিল না। কারণ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময় মূল্যায়ন করা হতো। অর্থাৎ তারা 'মেধার ভিত্তিতেই' সব পরীক্ষায় পার হয়ে আসে। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার সময়ই কেবল 'কোটা' বিবেচনা করা হয়। 

এই প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রহিত করার ঘোষণায় এতদিন কোটা সুবিধা ভোগকারীদের খানিকটা চিন্তিত করলেও বাস্তবে কোনো অসুবিধা হবে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সুবিধাই পাবে, যদি কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থার যথার্থ প্রয়োগ হয়। 

এ প্রসঙ্গে সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আমাদের আশ্বস্ত করে। তিনি যেমন বলেছেন, প্রজাতন্ত্রের সব চাকরি মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। এটি প্রজাতন্ত্রের সক্ষমতা অনেক গুণে বাড়িয়ে দেবে। কারণ আজকের পৃথিবী প্রতিযোগিতার পৃথিবী। সেখানে একমাত্র মেধাই পারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে। কিন্তু একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এটা প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য কতটা সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল।

মনে রাখা জরুরি, কোটা ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষেই একটি বিশেষ ব্যবস্থা। এই বিশেষ ব্যবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে প্রজাতন্ত্রের শূন্য পদগুলোর একটি অংশ প্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা অন্য কোনো শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট রাখতে হবে প্রথম থেকেই। তাদের জন্য আলাদা বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে এবং সেখানে বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত শ্রেণির প্রার্থীরাই শুধু আবেদন করবে। তাদের পৃথকভাবে মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা থাকবে। যেমন পৃথক প্রশ্নপত্র, পৃথক সাক্ষাৎকার বোর্ড। এভাবেই কেবল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সামাজিক ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে। প্রতিযোগিতা হবে পিছিয়ে পড়াদের মধ্যেই। এতে করে মূল্যায়ন হবে যথাযথ। আর আমাদের যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, তাদের এগিয়ে নিয়ে আসা; সেটিও পূরণ সহজ হবে।

আরেকটি বিভ্রান্তিও দূর করা জরুরি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী নয়। তারা নীতিগতভাবে কোটা ব্যবস্থার পক্ষে। কিন্তু এর প্রয়োগ নিয়ে তাদের মাঝে অসন্তোষ ছিল। যে কারণে তারা কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি করছিল। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ পদই মেধার ভিত্তিতে পূরণের দাবি জানিয়েছিল। আমাদের তারুণ্যবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ৯০ শতাংশের পরিবর্তে শতভাগই মেধার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এর চেয়ে উত্তম সমাধান আর কী হতে পারে? 

আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ঘোষণা অতি দ্রুত বাস্তবায়নের মাঝেই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিরসন সম্ভব। এখানে আমলাতান্ত্রিক কোনো জটিলতা যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, মেধার উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধনে তৎপর হওয়া। যাতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তারা সাফল্য অর্জন করে স্বদেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। 

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সাবেক উপাচার্য; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034558773040771