ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারা-ডোনার জন্য কাঁদছে ফুটবল বিশ্ব। শুধু ফুটবল বিশ্ব বললে ভুলই হবে। ম্যারাডোনার জন্য বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। রূপকথার রাজা ম্যারাডোনার জন্য কাঁদছে প্রায় সবাই। এভাবে হঠাত্ করে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ।
বুধবার আর্জেন্টিনার সময় দুপুর ১২টায় নিজ শহর বুয়েন্স আইরেসের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরন করেন ম্যারাডোনা। ডাক্তারদের বারণ সত্ত্বেও হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েন্স আইরেসের লানুসের একটি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ম্যারাডোনা ৬০ বছর বয়সে কোটি কোটি ফুটবল ভক্তকে কাঁদিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপ জয়ী তারকার মৃত্যুর খবর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়।
ব্রাজিলীয়ান ফুটবলের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি পেলে আফসোস নিয়ে বলেছেন স্বর্গে গিয়ে তিনি ম্যারাডোনার সঙ্গে ফুটবল খেলবেন। ম্যারাডোনার প্রতি এভাবেই তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করলেন ফুটবলের কালো মানিক পেলে। তাঁর মনে আছে, প্রায় একা একা খেলেই ম্যারাডোনা ১৯৭৯ সালে আর্জেন্টিনাকে যুব বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। ফুটবলের নান্দনিকতা কি, তা দেখিয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। এরপর এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ পায়নি।
ইংলিশ কিংবদন্তি ফুটবলার গ্যারি লিনেকার টুইটারে বলেছেন, ‘আমার প্রজন্মের ফুটবল ছিলেন ম্যারাডোনা। এটা খুব সহজেই বলা যায় সর্বকালের সেরা ফুটবলার ছিলেন ম্যারাডোনা।’
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে তিনদিনের জাতীয় শোক চলছে আর্জেন্টিনায়। দুনিয়া জুড়েই চলছে শোক। আর্জেন্টিনায় এখন শোকের মাতম। রাস্তায় রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষ। ম্যারাডোনার জন্য কান্না করছে। প্রার্থনা করছে। বুয়েন্স আইরেসে স্টেডিয়ামের সামনে গিয়ে মানুষ জড়ো হচ্ছে, যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার বাড়ির সামনেও লোকে লোকারণ্য। ফুটবল ঈশ্বরের জন্য সবার চোখে জল। প্রার্থনারত দুই হাত।
ম্যারাডোনা ছিলেন ফুটবলের শিল্পী। তাঁর ফুটবল নৈপুন্য ছিল অকল্পনীয়। গত দুই দিনে টিভিতে ম্যারাডোনার খেলা দেখে তো মেসি নেইমার প্রজন্মের দর্শকদের চোখ একেবারে ছানাবড়া। ম্যারাডোনার ফুটবল যাদু দেখে তারা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। ফুটবলের সেই যাদুকর প্রতিপক্ষের রক্ষণ দুর্গ ভেঙে টুকরো টুকরো করে গোলমুখে যেভাবে দ্রুতগতিতে ঢুকে পড়তেন, তা দেখে নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তারা।
১৯৮২ সালে ৫০ লাখ পাউন্ড চুক্তিতে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে খেলার ম্যারাডোনা বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে অপছন্দ করতেন। মনে করতেন ধনী দেশগুলো নানাভাবে অন্যদেরকে দরিদ্র করে রেখেছে। নিজে দরিদ্র পরিবার হতে উঠে আসলেও পরবর্তিতে ম্যারাডোনার ছিল বৈচিত্রময় জীবন। অর্থকড়ি হাতে থাকলে দেদারসে বিলিয়েছেন। বেহিসেবি ম্যারাডোনা অর্থকষ্টেও ভুগেছেন। কোনো কিছুই পাত্তা দিতেন না। ছিল বেপরোয়া জীবন-যাপন। বিভিন্ন দেশের ক্লাব কোচিংয়ে গিয়েও টিকতে পারেননি। পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। যাকে ভালোবাসতেন, তাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন। যাকে অপছন্দ করতেন তার ধারে কাছেও ভিড়তেন না এই ফুটবল কিংবদন্তি। বেশ একরোখা ছিলেন। একদম স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন তিনি।
ফিফার সভাপতিকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি ফুটবলের এই মহানায়ক। ফিফার কোনো বিষয় অপছন্দ হলে তিনি সমালোচনা করতেন। তারপরও ফিফা কখনো সমালোচনার কারণে ম্যারাডোনাকে শাস্তি দেয়নি। ফিফা ভালো করে জানতো ম্যারাডোনা ফুটবল খেলাটাকে কতো জনপ্রিয় করেছেন। ম্যারাডোনার কারণে টিভির ফুটবল দর্শক কতোটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দুনিয়ার বড় বড় স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ম্যারাডোনার পক্ষে ছিল। ম্যারাডোনা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে খেললে স্পন্সররাও ফিফার দিকে হাত আরো প্রসারিত করবে। এক কথায় ম্যারাডোনার কারণে ফিফার তহবিলও ফুলে ফেপে বড় হয়েছিল। ম্যারাডোনা ঠিকই যুক্তরাষ্ট্রে ৯৪ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। ওই বিশ্বকাপই ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ফকসবরো স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে মাঠ থেকে ডাক্তাররা ম্যারাডোনার ডোপ টেষ্ট করেন। টেষ্টে পজিটিভ শনাক্ত হন ম্যারাডোনা। তাঁর শরীরে এফিড্রিন পাওয়া যায়। এরপরই ম্যারাডোনা বাদ পড়েন বিশ্বকাপ ফুটবল হতে। তবে এটাও ঠিক যে এই ফুটবল ঈশ্বর নিজেকে জড়িয়েছেন নানা বিতর্কে। ইটালীতে খেলতে গিয়ে তিনি মাদক নিয়ে ধরা পড়েন। কোকেন শব্দটি ম্যারাডোনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। অ্যালকোহলেও আসক্তি ছিল তার। নিন্দা অনেক হলেও ভক্তদের ভালোবাসায় কমতি ছিল না। ম্যারাডোনা যেখানেই গেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছেন। তাই হয়ত রূপকথার রাজার জন্য আজ কাঁদছে গোটা ফুটবল বিশ্ব।