রাবিতে ঝরে পড়ছে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী - দৈনিকশিক্ষা

রাবিতে ঝরে পড়ছে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী

রাবি প্রতিনিধি |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন ৯০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক(সম্মান) পাস করেন ৩৬ জন। যা মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও কম। একই বিভাগে ২০১৩-১৪ এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৯০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এদের মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন যথাক্রমে ৪৮ ও ৪৩ জন।

শুধু পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেই নয়, প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, রসায়ন, ফলিত গণিত, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগ, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) বিভাগেও।

এই ৬টি বিভাগে প্রথম বর্ষে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তার প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীই নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক শেষ করতে পারছে না। একজন শিক্ষার্থী একাধিকবার ফেল করছে বিভিন্ন বর্ষে। বিভাগগুলোতে পাস করতে না পেরে প্রতিবছর ড্রপ-আউট হয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।

বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগের বিগত কয়েক বছরের ফল পর্যালোচনা করে করুণ চিত্র উঠে এসেছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিবছর ভর্তি হওয়া ৯০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ২১ জন, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ৩৫ জন, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ৪০ জন, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ৪৩ জন, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৪৫ জন, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৪৩ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪৮ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৩৬ জন। বাকি বর্ষগুলোতেও প্রায় একই সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর ফেল করছে।

গণিত বিভাগে ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ৭৫ জন করে শিক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন যথাক্রমে ৪০ জন ও ৪৫ জন শিক্ষার্থী। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া ১০০ জন করে শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেন ৬২ জন ও ৩৬ জন। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রতিবছর ভর্তি হওয়া ১১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে-২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৪৮ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৫৭ জন ও ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৫৫ জন স্নাতক পাস করেন।

রসায়ন বিভাগে ভর্তি হওয়া ১১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৫৪ জন, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৪ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৬২ জন ও ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৬৭ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন।

ফলিত গণিত বিভাগে ভর্তি হওয়া ৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৮ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪৫ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪১ জন স্নাতক পাস করেন।

ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগে প্রতিবছরে ৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নাতক পাস করেন- ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৪৩ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪৮ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪৬ জন।

ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ জন, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ জন, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৯ জন। পরে এ বিভাগকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে একীভূত (ইইই) করার পর ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাস করে ৩৭ জন ও ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪১ জন শিক্ষার্থী।

প্রায় একই অবস্থা বিজ্ঞানের অন্য বেশ কয়েকটি বিভাগেও। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগের ৯০ জনের মধ্যে ৬৩ জন, প্রাণরসায়ন ও  অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৫০ জনের মধ্যে ৩৯ জন, ফার্মেসি বিভাগের ৫০ জনের মধ্যে ৩৯ জন, পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউমেন রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ৬০ জনের মধ্যে ৩৪ জন পাস করেন।

উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৮৮ জনের মধ্যে ৭৩ জন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৮০ জনের মধ্যে ৬৮ জন, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ৬০ জনের মধ্যে ৪৫ জন, ক্রপ সায়েন্স বিভাগের ৫৬ জনের মধ্যে ৩৮ জন, ও এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ৫৬ জনের মধ্যে ৪৬ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন।

বিভাগগুলোর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, মূলত প্রথমবর্ষেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ফেল করছে। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষেও শিক্ষার্থীরা ফেল করছে। যেসব শিক্ষার্থী একবার ফেল করছে তাদের পরের বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে হয়। ফলে তারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং আর ভালো করতে পারে না।

এতো সংখ্যক ফেলের কারণ জানতে চাইলে বিভিন্ন বিভাগের মাস্টার্সের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, বিজ্ঞানের এ কঠিন বিষয়গুলোতে ভর্তির পর প্রথমবর্ষেই শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারেন না তাদের কীভাবে কি করতে হবে। বিভাগগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে থেকে সঠিক দিক-নির্দেশনা পায় না। এসব সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের খুব একটা কাছে যেতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের অনেক কঠোরভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নকেও দুষছেন অনেক শিক্ষার্থী।

অন্যদিকে শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো না বুঝে তারা বাজারের প্রচলিত নোট মুখস্ত করে পাস করতে চাইছে। যা কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে সম্ভব হলেও বিজ্ঞানে সম্ভব নয়। যারা নিয়মিত পড়াশোনা করছে তারাই ভালো ফল করছে। তাছাড়া বিভাগগুলোতে এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছেন, যাদের বিজ্ঞানের আগ্রহ নেই। এসএসসি ও এইচএসসি-তে নই শক্তিশালী ভিত্তি।

ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আবার অনেক শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব নেই। এছাড়া বিভাগগুলোতে এমন অনেক শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে যাদের বিজ্ঞানের ভিত্তি ভালো নয়।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সাজেশনে প্রশ্ন মুখস্ত করে ভালো ফল করে। আবার সংক্ষিপ্ত পড়াশোনায় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু তাদের ভিত্তিটা শক্তিশালী হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সিলেবাসের সঙ্গে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, এখন এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে, যাদের বিজ্ঞানে আগ্রহ নেই, নেই এসএসসি ও এইচএসসি-তে শক্তিশালী ভিত্তি। এদের মধ্যে থেকেই শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।

গণিত বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা রেগুলারিটি মেনটেইন করছে না। তাদের মধ্যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু গণিতের মতো কঠিন বিষয়ে একটি ক্লাস না করলে পরের ক্লাসে ওই শিক্ষার্থী কিছুই বুঝতে পারে না। এছাড়া শিক্ষার্থীরা না বুঝে সবকিছুই মুখস্ত করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা করে ফেলছে। এ অবস্থার সংস্কার না হলে আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া, বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। ক্লাসের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে ৩টি কারণ রয়েছে। প্রথমত শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যে পদ্ধতিতে পড়ালেখা করেছে, তা  মুখস্ত নির্ভর। তারা এই মানসিকতা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তারা তাল মেলাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, আমরা শিক্ষকরা ছাত্রদের মোটিভেট করতে পারছি না। তৃতীয়ত, ক্লাসে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বুঝাতে পারছে না। তাছাড়া এখন অল্প পরিশ্রমে ভালো ফল করার প্রতি সবার আগ্রহ। কিন্তু জ্ঞান ও শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ কম।

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036139488220215