সম্প্রতি ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া, নকল, শিক্ষকদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও জবাবদিহি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যখন স্পিকার ছিলেন তখনো তাঁর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।
অনেক বড় মনীষী রাজনীতিবিদকে দেখেছি তাঁর অতীতকে লুকাতে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম; বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কর্ণধার হয়ে অকপটে স্বীকার করতে পারেন তাঁর শিক্ষার মানের ঘাটতি থাকার কারণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। বুধবার (২৯ জানুয়ারি) কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপ-সম্পাদকীয়কে এ তথ্য জানা যায়।
উপ-সম্পাদকীয়কে আরও জানা যায়, মহামান্য রাষ্ট্রপতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উপচার্যের প্রতি যে অভিযোগগুলো তুলে ধরেছেন তা প্রতিটি সত্যি; বরং এর চেয়েও আরো অনেক তথ্য রয়েছে, সেগুলো যদি জনসম্মুখে আসে তাহলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগপত্র তৈরি হবে।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নকল ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নকল প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছিলেন। নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিভিন্ন কলেজে ছাত্রদের দ্বারা তাঁদের নাজেহালও হতে হয়েছিল। ছাত্ররা বহিষ্কৃৃত হয়েছিল, কেন্দ্র বাতিল হয়েছিল, তারপর কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছিল। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলো অধিভুক্তির পর থেকে নকল প্রতিহত বা রোধ করতে গিয়ে শিক্ষকদের নাজেহাল হতে হচ্ছে না। এর কারণ ছাত্ররা কি এখন নকল করে না? মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, নকল করার জন্য শিক্ষক, অভিভাবকরা অনেকাংশে দায়ী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জীবনে দেখেছি একাডেমিক কাউন্সিল বিভিন্ন কলেজের সেন্টারের অনিয়ম ও ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে, বিতর্ক হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত হয়েছে। এককভাবে বা কোনো সিন্ডিকেট দ্বারা সিদ্ধান্ত হয়নি।
যেমন একজন ছাত্র এইচএসসি পাস করার পর তার প্রথম লক্ষ্য থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরবর্তী সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়াশোনার আগ্রহ খুব কম থাকে। তার অন্যতম কারণ রীতিমতো ক্লাস না হওয়া। ক্লাস না হওয়ার কারণ প্রতি সপ্তাহে বা প্রায় কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে। যেহেতু পরীক্ষার জন্য কলেজগুলোতে হল নেই, তাই ক্লাস বন্ধ থাকে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকের দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই ছাত্রদের ভর্তি করিয়ে নেয়। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় প্রচুর বেড়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশের ভর্তিপ্রক্রিয়া তার ইচ্ছামতো বা পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে কি না অনিশ্চিত। যখন সে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে, তখন এখান থেকে মাইগ্রেশন নিতে হয়। কিন্তু কোনো টাকা ফেরত পায় না; বরং মাইগ্রেশনের জন্য আবার অর্থ দিতে হয়।
এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, ঢাকা কলেজসহ ঢাকায় অবস্থিত সাতটি অনার্স কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অফিস ঘেরাও করতে হয়েছিল। মূলত দুই উপাচার্যের দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রদের ভবিষ্যতে অন্ধকার নেমে আসে। এটা কিভাবে সমাধান হচ্ছে আমার জানা নেই। তবে এটা বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার মান উন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা কার্যত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষাকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এবং এই সরকার উন্নয়ন খাতে প্রচুর ব্যয় করছে। বর্তমানে উপাচার্য নিয়োগের প্রধান মাপকাঠি তদবির, রাজনৈতিক মতাদর্শ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পরিচালনায় অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব পালন না করা অনেক শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম না জানলে তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন কিছু শিক্ষক অথবা কর্মচারী, কর্মকর্তার ওপর। যেহেতু উপাচার্যের প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া আছে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে, তাই তিনি তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে শাসন কাঠামো সাজিয়ে থাকেন এবং দুর্নীতি করলে কেউ তাঁকে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা উপাচার্যের সঙ্গী হয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করেছিলেন, তাতে যে প্রশাসনিক চিত্র পাই তার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একই চিত্র।
রাষ্ট্রের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কাঠামো রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধারণা নিতে যেন কোনো সমস্যা না হয় এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক নেতাদের মতো অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন করে আসতে হয়। রাজনৈতিক নেতাদের মতো যেন শিক্ষকরাও ছাত্র-শিক্ষক এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করার মনমানসিকতা তৈরি হয়।
একজন প্রধানমন্ত্রীকে কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয় জনগণের কাছে, অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে দাঁড়ালে তাঁর কর্ম জনগণের জন্য কী কী করেছে সেই তথ্য নিয়ে ভোটের জন্য হাজির হতে হয়; কিন্তু পক্ষান্তরে একজন উপাচার্য এই জবাবদিহির বলয়ের বাইরে রয়েছেন। বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর যেমন ক্ষমতা, তার থেকে বেশি ক্ষমতা একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের। কারণ চার বছর পর তাঁর কৃতকর্মের কোনো ধরনের হিসাব বা কাজ মূল্যায়ন করার কোনো রেওয়াজ নেই।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, একজন উপাচার্য জড়িত হয়ে পড়েন টেন্ডারবাজিতে, দুর্নীতিতে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি সম্মানের নয়, এটি একটি ব্যাবসায়িক পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অথবা উপাচার্যের ওপর ন্যস্ত না করে সরকারি এজেন্সি দ্বারা উন্নয়নমূলক কাজগুলো যদি করা হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
বর্তমানে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, সেগুলোতে বিভিন্ন নতুন নতুন বিভাগ চালু করার সময় দেখা যাচ্ছে, একজন সহকারী অধ্যাপক একজন প্রভাষক, বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা বিভাগীয় প্রধান। অভিজ্ঞতাহীন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য উপযোগী সিলেবাস তৈরি করতে বা অন্যান্য কাজ করতে তিনি কখনো দক্ষ হবেন না। যেমন দেখা যায় একজন প্রফেসরকে প্রথম নিয়োগ দিয়ে সেই বিভাগকে গড়ে তুলতে। আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে যখন যাত্রা শুরু করে তখন বিভিন্ন বিভাগে প্রথিতযশা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
কিন্তু বর্তমান উপাচার্যরা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না; বরং যেসব নিয়োগ হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা, অর্থ, রাজনীতি মতাদর্শ কাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন দল-মত-শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত একটি একাডেমিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠবে, যা বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারবে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আরো বলেছেন, শিক্ষকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের না পড়িয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তাঁর সব কথাই বাস্তবসম্মত ও সত্য। এর বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাণিজ্য অনুষদ, ইংরেজি বিভাগ, আইন বিভাগ—সবই একাডেমিক ক্যালেন্ডার হিসেবে অন্ততপক্ষে এক বছর পিছিয়ে রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি যখন এ বিষয়গুলো বলছিলেন তখন তাঁর চোখে-মুখে দেখেছি ক্ষোভ, বেদনা, হতাশা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির হতাশা, বেদনা, ক্ষোভ দূর করার জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
লেখক : গাজী সালেহ উদ্দিন, সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়