শিক্ষকদের গুরুত্বহীন রেখে শিক্ষার মান ভালো করা সম্ভব নয় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের গুরুত্বহীন রেখে শিক্ষার মান ভালো করা সম্ভব নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে আমাকে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট থাকতে হয়েছে। এই সংশ্লিষ্টতা সংগত ছিল কি না তা আমার সাহচর্যে আসা শিক্ষার্থীরা বলতে পারবে। আমিও কিছুটা বলতে পারি। সত্যি কথা বলতে কী, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট হওয়া আমার উচিত হয়নি।

‘প্রিন্সিপল অব মোহামেডান ল’ মূলগ্রন্থ ‘নূরুল আনোয়ার’, সেখানে বলা হয়েছে, ‘আজজরুরাতো তুবেউল মা’য়াজুরাত’, যার সার সংক্ষেপ—জীবন বাঁচাতে মড়াও খাওয়া যায়। ভিন্ন অর্থে রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলার’ অশোকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। ’ বুধবার (১৮ মে) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ-মাদরাসা ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমি উচ্চশিক্ষার সনদ জোগাড়ের জন্য শিক্ষা শ্রম দিয়ে ‘পারানির কড়ি’ সংগ্রহ করেছি। মাদরাসায় পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেতে পেতে আমার সরকারি চাকরি প্রাপ্তির সর্বোচ্চ বয়স (২৫ বছর) শেষ হয়ে যায়। তবে সরকারি কলেজে চাকরির জন্য বয়সের সুবিধা থাকায় পরীক্ষা দিয়ে সেই ‘আকাশের চাঁদ’ লাভ করি। এত সব ধারাবাহিকতা বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, পাঁচমিশালি প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে শিক্ষা আর শিক্ষকের হালহকিকত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা গ্রহণে বাধ্য হওয়া। তার কিছু বিষয়ের সঙ্গে বর্তমানের শিক্ষা আর শিক্ষককে মিলিয়ে দেখার সুবিধার্থে এই গৌরচন্দ্রিকা। গত শতকের মাঝামাাঝি সময়ে আমরা শিক্ষক দেখেছি। শিক্ষা ব্যবসায় তখনো রমরমা হয়ে ওঠেনি। অনেক শিক্ষক অভাবগ্রস্ত হয়েও নিজের দীনতা প্রকাশে লজ্জায় মুখ ঢাকতেন। অথচ তাঁদের নিষ্ঠার অভাব ছিল না। প্রত্যুষে কৃষিকাজে অংশ নেওয়ার পর স্কুল সময়ে উপস্থিত হতেন। তাঁদের জানার সবটুকু উজাড় করে দিতেন। এখন দিন বদলেছে। গৃহবধূরা প্রাথমিকের শিক্ষকতায় এসেছেন। তাঁদের শতকরা কতজন গৃহকর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষায় সনিষ্ঠ তা আমরা পরখ করি না। করতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তবু বলব, এটা শিক্ষা কোটার অবদান কি না, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। মাধ্যমিকে এসবের ব্যতিক্রম তেমন ছিল না। এখনো তথৈবচ।

সেকালে কলেজের নাম শোনা গেছে। অনেকের চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৯৫৫ সালের আগে আদিনা ফজলুল হক কলেজ (১৯৩৭) ছাড়া আর কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। আমি মাদরাসায় পড়েছি। হুজুররা ঐহজাগতিকতা অপেক্ষা পারত্রিকতায় বেশি জোর দিতেন। তাঁদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সেসবের মিল ছিল কম। অনেকে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, অথচ নিজেদের সন্তানদের সেমুখো করেননি।

একটু চোখ মেলে দেখলে আর কান খুলে শুনলে আমাদের শিক্ষার বেহাল দশা ধরা পড়বে। কিছু তথাকথিত সনদধারী উচ্চাভিলাষী তথাকথিত শিক্ষক দুর্বৃত্তদের হার মানিয়েছেন। পত্র-পত্রিকায় যার খবর আসে।

চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর লেখালেখি শুরু করি। যদিও বিধিদত্ত সৃজনক্ষমতা আমার তিল পরিমাণও নেই। সাহিত্য ও সমাজের সঙ্গে প্রথমাবধি শিক্ষা নিয়ে দু-চার পাতা লিখেছি। অনেক পাঠক বলেছেন, এটা ‘অরণ্যে রোদন’ বা ‘উলুবনে মুক্তা ছড়ানো’। যাঁরা বিষয়গুলো পড়লে শিক্ষাক্ষেত্রের অপবাদগুলো দূর হবে, তাঁরা এসব পড়ার সময় পান না। এ অনুমান সর্বাংশে সত্য নয়। সমাজের মৃদু গুঞ্জন এখন আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ পীঠস্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষার সুদিনের জন্য অপেক্ষা করব। শুধু ক্ষমতা রক্ষা নয়, শিক্ষা ও সমাজকে ঈর্ষণীয় করে তোলার ব্রতে তাঁরা অক্লান্ত হবেন।

আইনপ্রণেতারা উচ্চশিক্ষার বেহাল অবস্থা নিয়ে ভাবছেন। এর পেছনে আমরা কিছুসংখ্যক সনদধারী ব্যক্তি কম দায়ী নই। দেশভাগের পর অর্ধশিক্ষিতরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে অনাসৃষ্টি কম করেননি। প্রতিষ্ঠানপ্রধান কিংবা সব্যসাচী শিক্ষকের বিরুদ্ধে লেগে তাঁকে উত্খাত না করা পর্যন্ত ছাড়েননি। সেই ধারা দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। তাই প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা আগে থেকেই কোমর বেঁধে সরকারি দলের কর্মী সেজে বিরোধিতার মোকাবেলা করেন, ফলে অন্ধকার কাটে না।

সরকারের আশীর্বাদে ১৯৭৯-৮০ সাল থেকে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হয়েছে। এতে সনদধারীর সংখ্যা বেড়েছে, মান বাড়েনি। মূল আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ঘরে ডেকে পড়িয়ে অর্থ উপার্জনের সংস্কৃতি গুলজার করেছেন। এখন আবার নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্তির জন্য অনেকে মোসাহেবকে দালাল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। দালালরা আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক নয়। এমনকি যাঁর জন্য দালালি, তিনি বিপরীতমুখী। সুযোগ পেয়ে প্রতিপত্তি বাড়ানোর পাঁয়তারা আর বাহ্যিকের আড়ম্বর সর্বস্বতা, উদ্বোধন আর পাতা কুড়ানোয় লীন। জ্ঞান ও মনুষ্যত্ব অটুট রাখার কর্মসাধনায় দৃশ্যমান হন না।

এখন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে। একটা পরমাশ্চার্য ব্যাপার যে অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাননি, অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিয়োগের সময় তাঁদের মেধা কিংবা কোষ্ঠী দেখা হয় না। তাই হ-য-ব-র-ল কাটে না। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর কাছে সন্তানতুল্য ছিল। এর প্রতিটি ধূলিকণাকে তিনি মধুময় ভাবতেন। জ্ঞানপীঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি জ্ঞানের আকর দেখতে আগ্রহী ছিলেন। ক্ষমতালোভী ছদ্মবেশী রাজনীতিকের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন না। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তিনি করেছিলেন। উদ্দেশ্য, শিক্ষাকে সর্বজনীনতা দান করা। হয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক দার্শনিক সাইদুর রহমান বলতেন, লোভীরা ‘হগলটাই’ দখল করতে উদ্যত হয়। তাই হয়েছে।

ব্রিটিশরা উচ্চপদে নিয়োগ দিতে কোষ্ঠী যাচাই করত। পাকিস্তানিরা তা আংশিক বজায় রাখে। এ জন্য দেখা গেছে, ওই সময়ে সনদে নাম পরিবর্তনের হিড়িক। কারণ যেনতেন নামে ব্যক্তির পারিবারিক ঐতিহ্য ধরা পড়ে। যদিও বলা হয়, ‘নামে কিবা আসে যায়’। তাই বলে ময়ূরপুচ্ছ লাগালেই তো স্বভাব যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের সময় প্রার্থীর মেধা ও ঐতিহ্য দেখা দরকার। তা হয় না। কী হয়, সেটা গোপন থাকে না।

১৯৭৩-এর অ্যাক্টের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির হাট বসেছে। শিক্ষকরা ক্ষমতা দখলের কৌশল খোঁজায় সময় বেশি দেন। ফলে শিক্ষা দিগন্তে গিয়ে ম্রিয়মাণ। যদিও শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়া আশা রাখেন ‘উচ্চশিক্ষার মান আরো ভালো করা সম্ভব। ’ আমরাও আশাবাদী। তবে প্রকৃত মেধাবী দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী শিক্ষকদের গুরুত্বহীন রেখে সহজ নয়।

ছলে-বলে-কলে-কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারীরা ‘মোড়ল’ হয়ে বসেন। তাঁরা শিক্ষার অন্তর্নিহিত সত্তার খোঁজ রাখেন না। জানেন ক্ষমতা কুর্নিশ করে আহল-আইয়ালের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করতে। দেশ ও শিক্ষা গোল্লায় গেলেও তাঁরা ভাবিত হন না। এ অবস্থা প্রকট দেখে শিক্ষার হালহকিকত নিয়ে কথা উঠেছে সংসদে। আমরা মনে করি, এটা শিক্ষার জন্য সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের ক্ষীণ আলোর মতো।

একদা রাজনীতিক এবং আমলারা প্রকৃত শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানিয়ে সমীহ করতেন। এখন ক্ষমতার লাঙুলধারী শিক্ষকরা আমলা (নিম্ন পর্যায়ের হলেও) ও রাজনীতি পেশাধারীদের সালাম দিতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করেন। এ অবস্থায় জ্ঞানের জন্য, মনুষ্যত্বের জন্য শিক্ষা কোথায় আশ্রয় খুঁজবে।

 

লেখক : গোলাম কবির, সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.019624948501587