শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্ববিদ‍্যালয় হলো একটা সমাজের লাইট হাউস। বিশ্ববিদ‍্যালয় যদি লাইট হাউস হতে না পারে, তাহলে সমাজে সেটার দৃশ‍্যত প্রভাব পড়ে। সমাজের প্রতিবিম্বেই একটা দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোর অবস্থার প্রমাণ মেলে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের সংখ‍্যা বেড়েছে। প্রতিবছর সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ‍্যা বেড়েছে। কিন্তু সংখ‍্যাকে ছাড়িয়ে গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা পিছিয়ে আছে। শিক্ষা ও গবেষণার বৈশ্বিক মানদণ্ডে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক পেছনে। বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থান করে নিতে পারছে না। বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, উচ্চশিক্ষায় যদি আমরা গুণগত মান বাড়াতে না পারি, তাহলে বিশ্বমানের তরুণ তৈরি করা দুরূহ হবে। আর সেটা না পারলে বৈশ্বিক দ‍ৌড়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে। দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোকে যদি বিশ্বমানের করতে হয়, তাহলে দরকার একটা শিক্ষাবিপ্লব। এ প্রবন্ধে সেই বিপ্লবের জন‍্য করণীয় কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো।

বিশ্ববিদ‍্যালয়ে সব ধরনের দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ৫০ বছর ধরে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে এই ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির কারণে শিক্ষার মান ও পরিবেশের অনেক অবনতি হয়েছে। আফ্রিকার বহু দরিদ্র দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন নোংরা রাজনীতি নেই। বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন‍্য স্টুডেন্ট ইউনিয়ন থাকবে। কিন্তু সেসব ইউনিয়নের সঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজনীতির কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কথা বলার এবং মুক্তচিন্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি থেকে নেতা-নেত্রীর সব ধরনের পোস্টার, দেয়াললিখন ইত‍্যাদি পরিষ্কার করতে হবে। ভবিষ‍্যতে যেন পোস্টার, দেয়াললিখন না হয়, সে আইন করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয় ক‍্যাম্পাস কোনো রাজনৈতিক দলের বৈঠকখানা নয়। দুনিয়ার কোনো সভ‍্য ও মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ‍্যালয়ের দেয়াল নেতা-নেত্রীর পোস্টার দিয়ে ছেয়ে থাকে না।

গণহারে ডিপার্টমেন্ট খুলে স্টুডেন্ট ভর্তি বন্ধ করতে হবে। কয়েক বছর পর পর নতুন নতুন বিশ্ববিদ‍্যালয় না খুলে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর মান বৃদ্ধির লক্ষ‍্যে কাজ করা প্রয়োজন।

পিএইচডি ছাড়া বিশ্ববিদ‍্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ধীরে ধীরে বন্ধ করতে হবে, অন্তত বিজ্ঞান অনুষদে। শিক্ষক নিয়োগের জন‍্য বিষয়ভিত্তিক এক্সপার্ট কমিটি গঠন করে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ‍্যতা ও গবেষণা যাচাই-বাছাই করে সবচেয়ে যোগ‍্য প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে এক্সপার্ট কমিটিতে বিদেশি শিক্ষক বা গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের গবেষণার জন‍্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের আরও উৎসাহিত করতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয়কেন্দ্রিক মৌলিক ল‍্যাবরেটরি (Key Laboratory) স্থাপনের পরিকল্পনা করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোয় উন্নতমানের পিএইচডি ডিগ্রি চালু করে দেশেই বিশ্বমানের পিএইচডি গবেষক তৈরি করতে হবে। তা না হলে বিজ্ঞান গবেষণায়, আবিষ্কার-উদ্ভাবনে আমরা স্বনির্ভর হতে পারব না কোনো দিনই। সার্বিকভাবে উন্নত গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অধীন কলেজের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন‍্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিতে ব‍্যর্থ হলে, তাঁদের কাছ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো শিক্ষকতা আশা করা অসম্ভব।

বিশ্ববিদ‍্যালয়ের বিভাগগুলোয় নিয়মিত আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, রিসার্চ কোলাবোরেশন ইত‍্যাদির জন‍্য তাগাদা দিতে হবে। এই সব কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে ডিপার্টমেন্টের বাজেট বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে হবে।

আবাসিক হলগুলো রাজনীতির আখড়া না বানিয়ে, নিয়মানুযায়ী ছাত্রদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয়ের আবাসনকে বেসরকারীকরণের জন‍্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে। দুনিয়ার বহু উন্নত দেশে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের এফিলিয়েটেড কোনো ছাত্রাবাস থাকে না।

সব পাবলিক বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পাস নম্বর অন্তত ৫০ বা ৬০ শতাংশ করতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর খাতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

বিশ্ববিদ‍্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ-উপদেশ শুনতে বাধ‍্য করা যাবে না; বরং ইউজিসিতে নিয়োগ দিতে হবে চলমান গবেষণার সঙ্গে জড়িত আছেন এমন শিক্ষক ও গবেষকদের, যেসব শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণাজীবন খুবই উন্নত, যাঁরা বিশ্ব শিক্ষাব‍্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ও অভিজ্ঞ। ইউজিসির কমিটিতে বিদেশি গবেষকদের সম্পৃক্ততা রাখার পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ‍্যালয়ে উন্নতমানের ওয়েবসাইট থাকতে হবে। সব শিক্ষকের বিস্তারিত একাডেমিক যোগ‍্যতা সেসব সাইটে প্রকাশ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন‍্য একাডেমিক আইডি নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয় শিক্ষার্থীদের ক‍্যাম্পাসে (অনুষদে, লাইব্রেরিতে) ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের সুবিধা দিতে হবে।

ঘৃণ‍্য সেশনজট বন্ধ করতে হবে। ৫০ বছর বয়সী একটা দেশে সেশনজটের মতো নোংরা বিষয় থাকতে পারে না। সারা দুনিয়ায় শিক্ষার্থীরা গড়ে ২০-২১ বছর বয়সে স্নাতক পাস করে। আমাদের দেশেও সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকদের মূল‍্যায়নের সুযোগ রাখতে হবে। দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার জন‍্য ব‍্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে উত্তরপত্র মূল‍্যায়নের পুরোনো নিয়ম বদলাতে হবে।

রাষ্ট্রপ্রধানদের পছন্দমতো ভিসি নিয়োগ বন্ধ করতে হবে, দায়িত্ব দিতে হবে বিশ্ববিদ‍্যালয়কে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত ভিসি দিয়ে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মঙ্গল ও গুণগত মান বৃদ্ধি অসম্ভব। একজন ভিসি যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই সময় ব‍্যয় করেন, তাঁর হাত দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধি হবে না কখনোই।

বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোর সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ইন্ডাস্ট্রি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ইত‍্যাদির যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন কোনো বাধা ছাড়া সেসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ইন্টার্ন, প্রজেক্ট বা রিসার্চ ওয়ার্ক করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ‍্যালয়ের গবেষণায় অর্থায়নের জন‍্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দিতে হবে।

ব‍্যাচেলর পর্যায়ে সবার জন‍্য রিসার্চ ওয়ার্ক চালু করতে হবে। অন্তত বিজ্ঞান অনুষদে। থিসিস ছাড়া মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। মাস্টার্স থিসিস বা পিএইচডির শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়াতে হবে, যেন তাঁরা গবেষণায় উৎসাহী হন। বিশ্ববিদ‍্যালয়ে মানসম্পন্ন জার্নালগুলোর প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কুম্ভিলতা (Plagiarism) ও দুর্বল মানের গবেষণা প্রতিহত করতে কঠোর হতে হবে।

ব‍্যাচেলর স্টুডেন্টদের অন্তত একই অনুষদের মধ‍্যে অন‍্যান‍্য বিভাগের কোর্স করার সুযোগ দিতে হবে। একজন শিক্ষার্থী এক বিভাগে ভর্তি হয়ে একই অনুষদের অন‍্য বিভাগে ডিগ্রি নিতে চাইলে, সেই সুযোগ রাখতে হবে। আগ্রহী ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন পর্যাপ্ত ক্রেডিট সম্পন্ন করে সময়ের আগেই ডিগ্রি নিতে পারেন, সে ব‍্যবস্থাও রাখা উচিত। বিভাগের কোর্স ডিজাইনে উন্নত বিশ্বের বিভাগগুলোকে অনুসরণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া, দেশের চলমান শিল্পাঙ্গন ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মূল‍্যায়ন করে কোর্স ডিজাইন করা যেতে পারে। সময়ে-সময়ে তাতে পরিবর্তন আনতে হবে।

শিক্ষকদের পদোন্নতিতে বয়সকে গুরুত্ব না দিয়ে, তাঁদের কাজ, তাঁর একাডেমিক, প্রশাসনিক ও গবেষণার সাফল‍্যকে বিবেচনা করতে হবে।

বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ক‍্যাম্পাস হলো বিশ্বাঙ্গন। সেখানে যেকোনো দেশের শিক্ষার্থীকে স্বাগত জানাতে হবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর যেকোনো দেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করে। তাঁদের মেধাকে সমাজের জন‍্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। দেশের উচ্চশিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হলে আজ হোক কাল হোক, এই পরিবর্তনগুলো আনতেই হবে। যত দ্রুত, ততই মঙ্গল।

লেখক : ড. রউফুল আলম, সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, পিটিসি থেরাপিউটিকস, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.022109031677246