শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর। এ কারিগরদের দুঃখ, বেদনা ও অপমানের সাথে সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষক সমাজ ও জনগণের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ধামরাই উপজেলার সূত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তি সাথে সাথে গ্রেফতার। অথচ নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার আসামী চিহ্নিত করার জন্য সময়ক্ষেপণ শিক্ষক সমাজ ও পুরো জাতিকে হতভম্ব ও বিস্মিত করেছে।
সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে মারধর ও কান ধরে উঠবস করানো ঘটনা তা শিক্ষক সমাজ কোন মতেই মেনে নিতে পারছে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে ওসমান পরিবারের অবদান স্বাধীনতাকামী পুরো জাতি যেমন আজীবন স্মরণ করবে। তেমনি শিক্ষক সমাজ তথা বিবেকবান সকল মানুষ শিক্ষক লাঞ্ছিত করার জন্য সেলিম ওসমানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। যেখানে আমাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সেলিম ওসমান পুরো জাতির সামনে কানে ধরে উঠবস করে শিক্ষকের পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থণা করবে।
এর পরিবর্তে সংবাদ সম্মেলনে বেয়াদবের ভূমিকা নিয়ে হুংকার প্রদর্শন করেছেন। শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস ঘটনা পুরো শিক্ষক সমাজকে কানে ধরে উঠবস করাচ্ছেন। শিক্ষকদের দুঃখ কষ্ট বেদনা প্রসঙ্গে এ লেখা লেখতে গিয়ে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাদটিকা গল্পের পন্ডিত মহাশয়ের স্মৃতি আজ ভেসে উঠলো মনে। পন্ডিত মহাশয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন- “বলতো দেখি লাট সাহেবের কুকুরের পেছনে মাসে ৭৫ টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের যদি তিনটি ঠ্যাং থাকে। তবে প্রতিটি ঠ্যাংয়ের জন্য কত টাকা খরচ হয়? ছাত্ররা উত্তরে বললো ২৫ টাকা। তারপর পন্ডিত মশাই বললেন উত্তম উত্তর। অপিচ, আমি ব্রাহ্মণী বৃদ্ধ মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা।
ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কটা ঠ্যাংয়ের সমান। পুরো শ্রেণির ছাত্ররা মাথা নিচু করে বসে রইল। সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ। পন্ডিত মশাই মুখ লজ্জা, তিক্ততা ও ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে, কেউ বাদ যায়নি পন্ডিত মশাই আত্ম অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন আমাদের সাক্ষ্মী রেখে। পন্ডিত মশাই যেন উত্তরের প্রতীক্ষায় বসেই আছেন। এই নিস্তব্ধতার স্মৃতি আমাদের মনে থেকে মুছে যায়নি।
আজ নারায়ণগঞ্জের ঘটনা শিক্ষক সমাজ, শিক্ষার্থী ও পুরো জাতিকে করেছে বিহ্বল। পুরো জাতি আজ নিস্তব্ধ। পন্ডিত মশাই আজ বেঁচে থাকলে এ ঘটনাটি কীভাবে জাতির অঙ্গে মাখতেন জানি না? শিক্ষা নিয়ে জাতীয় বাজেটে কৃপণতা, বেসরকারি শিক্ষকদের লজ্জাজনক বাড়ি ভাড়া, প্রাথমিক শিক্ষকদের থার্ড ক্লাস মর্যাদা রাখার ভাবনা, সর্বোপরি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গসহ অধিকার হরণ এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
স্বাধীন সভ্য দেশে এ বর্বর কর্মকান্ড তামাশা দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মাননীয সংসদ সদস্যরা দেশের আইন প্রণেতা। বিচারক বা দণ্ড কার্যকরের দায়িত্বে নিয়োজিত কেহ নয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নাটক সৃষ্টি অপ্রয়াস চালানো প্রচেষ্টারত। তিনি স্বশরীরে উপস্থিত থেকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে নিজের হাতে দণ্ড কার্যকর করতে পারে না। তিনি শুধু শিক্ষক সমাজ ও পুরো জাতিকে অপমানই করেন নাই। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যরা এ থেকে বাদ পড়তে পারে না। তিনি পুরো জাতির ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে হেয় করেছেন।
পুরো জাতি তার এ ঘৃণ্যতম কর্মকা-ের অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করছে। প্রত্যেক নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান অপরাধী। ধামরাইয়ের শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী জেলে। অথচ সেলিম ওসমান হুঙ্কার ছড়াচ্ছে। এর প্রতিবাদে প্রাথমিকের সকল শিক্ষক সংগঠন প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরামের আহ্বানে ১৯ মে ঐক্যবদ্ধভাবে সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করেন।
শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি বাতিল ও প্রধান শিক্ষককে বহাল রাখার ঘোষণা দেওয়ায় অভিনন্দন জানাচ্ছি। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে গ্রেপ্তার না করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় না করানোর জন্য তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
সেলিম ওসমানকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় না করালে আমরা প্রাথমিক শিক্ষক সমাজসহ সকল শিক্ষককে নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেব। সেলিম ওসমান ভাবা উচিত ছিল তিনি কাকে কান ধরাচ্ছে? এ কান শ্যামল কান্তি ভক্তের নয়। এ কান সমাজের শিক্ষাগুরুর। তিনি শিক্ষকদের মর্যাদা হানিকর বর্বরতম কাজ করছে।
শ্যামল কান্তি ভক্তকে যদি মেরেও ফেলতো তাহলে শিক্ষক সমাজ এত ব্যথিত হত না। সংসদ সদস্য নিজেকে প্রকৃত মুসলমান দাবি করছেন। কোন সাধারণ মুসলিম এ রকম জঘন্য কাজ করতে পারে না। হায়রে বাংলাদেশ! দেশের প্রচলিত আইনে সবকিছু হবে। অথচ দুঃখ ও বেদনা নিয়ে বলতে হয় সকল মন্ত্রণালয় যেন বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা বসে থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী যেই হোক অপরাধী হিসেবে যাতে দ্রুত শাস্তি পায় এ প্রত্যাশা সকলের। আসুন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে শিক্ষকের এ অবমাননার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।
লেখক: আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম।