জেএসসি ও জেডিসি, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার ফল গত মঙ্গলবার একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় অর্ধ কোটি পরিবারে এখন উচ্ছ্বাস। আর স্কুলে বইছে আনন্দের বন্যা। ভালো ফল করে নেচেগেয়ে উৎসব করছে শিক্ষার্থীরা। এবার জেএসসিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ বেড়েছে, জেডিসিতে পাসের হার বাড়লেও কমেছে জিপিএ-৫। এছাড়া প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনীতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটিই কমেছে। শনিবার (৪ জানুয়ারি) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় যারা ভালো করেছে তাদের সবাইকে অভিনন্দন। যারা তেমন ভালো করতে পারেনি তাদেরও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কোন পরীক্ষার ফলাফল কখনই পড়ালেখার ক্ষেত্র বন্ধ করতে পারে না। জানার আগ্রহই জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়, মানুষকে আলোকিত করে, সমৃদ্ধ করে।
শিক্ষা সমাপনীর ফলাফলে উৎসবের আবহ তৈরি হলেও শিশু-কিশোরদের মেধাবিকাশে এ ধরনের পরীক্ষা কতটুকু জরুরি তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষানুরাগীদের দাবি ছিল, প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করা। ২০১০-এর জাতীয় শিক্ষানীতিতেও পরীক্ষা কমানোর কথা বলা হয়েছিল। শিশুদের ওপর থেকে পরীক্ষা ও বইয়ের ভার কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও। অথচ জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম সমন্বয় কমিটি জুনিয়র পরীক্ষার বিষয় ও নম্বর কমালেও প্রাথমিক পরীক্ষা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শিশু-কিশোরদের ঘাড় থেকে পরীক্ষার বোঝা কমানোর ব্যাপারে কারও কোন উদ্যোগ নেই। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়, যা সম্ভবত অন্য কোন দেশে নেই। প্রতিবেশী ভারতসহ বেশির ভাগ দেশে দুটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। বাংলাদেশেও এক সময় দুটি পরীক্ষা নেয়া হতো। হঠাৎ করে দুটি কিভাবে চারটি হলো, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না। অথচ শিক্ষার্থীদের ওপর চারটি পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়ায় তারা শ্রেণীকক্ষমুখী না হয়ে পরীক্ষামুখী হয়ে পড়েছে। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোট বই, গাইড বই তাদের কাছে এখন অধিক আকর্ষণীয়। দুর্ভাগ্য যে, শিক্ষার্থীদের বেশি নম্বর পাওয়ানোর এ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অভিভাবকরাও। ফলে কোচিং সেন্টারগুলোই বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। আর এ সংক্রামক ব্যাধি শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। শিক্ষার এ পরিণতির জন্য দায়ী তারা, যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের আগে শিশুদের ওপর চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে তাদের মানসিক অগ্রগতি পঙ্গু করার প্রয়াস পাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষা একটি সমন্বিত প্রয়াস এবং এর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অব্যাহত অনুশীলন। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নীতিনির্ধারকরা কিসের ভিত্তিতে পরীক্ষা চালু করেন, কিসের ভিত্তিতে নম্বর ও বিষয় কমান সেটা কেউ জানে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এমসিকিউ থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়েও সুপারিশ আসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। পরীক্ষা, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয় আছে বলে মনে হয় না। দেশের সাধারণ মানুষের দারুণ দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের সন্তানদের জন্য যারা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেন সেই আমলারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করান বিদেশে, নয়তো দেশের মধ্যে মূলধারার বাইরে এলিট শ্রেণীর স্কুলে। যারা শিক্ষা প্রকল্প তৈরি করেন তাদের এসব তৈরির সময় ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন পড়ে না। জনগণের কোন প্রয়োজনে করছেন, দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে করছেন তাও ভাববার কোন প্রয়োজন পড়ে না তাদের। মতলবে বা সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থে তাদের মাথায় এলেই হয়ে গেল। সেটাই নীতিতে পরিণত হয় জনগণের জন্য।
শিশুদের পড়াশোনার চাপ থেকে বাঁচাতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, বইয়ের বোঝা কমাতে হবে। আধুনিক যুগে যারা শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে শিশুর বিকাশ হওয়া দরকার। তথাকথিত শিক্ষার চাইতে শিশুর বিকাশটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষক একটা বাচ্চাকে পড়ান, তিনিই হলেন তার জন্য শ্রেষ্ঠ পরীক্ষক। তাকেই ওই শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের দায়িত্ব দিতে হবে। একটা স্কুলে যদি নিয়মিত পাঠদান হয়, আর শিক্ষার্থীরা যদি নিয়মিত আসে সেটাই তো তার বড় মূল্যায়ন। আর এত বিষয়েও পরীক্ষা নেয়ার তো কোন দরকার নেই। এত পাবলিক পরীক্ষারও একেবারেই প্রয়োজন নেই। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানেই মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে তা বোঝাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে প্রয়োজনে এ ব্যাপারে একটি ন্যাশনাল টাস্কফোর্স করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সেই টাস্কফোর্স হতে হবে শিক্ষাবিদদের নিয়ে; কোনভাবেই আমলাদের দিয়ে নয়। শিশুদের ওপর থেকে পরীক্ষা এবং বইয়ের ভার কমাতে হবে। গোড়া থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার বর্তমান কৌশল অব্যাহত রাখার কোন যুক্তি রয়েছে বলে আমরা মনে করি না।