শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনুদান দেয়া কি অপরাধ? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনুদান দেয়া কি অপরাধ?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সময়টা ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকের রাস্তায় উগ্রপন্থীদের চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন লেখক ও অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। আমরা তখন বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। হুমায়ুন আজাদ স্যার আমাদের সরাসরি শিক্ষক। তাঁর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সে সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। সেটা ছিল আমার মতো অনেকের জীবনের প্রথম আন্দোলন। প্রথম মিছিলে স্লোগান তোলা।

আন্দোলনের একদিনকার কর্মসূচি ছিল প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আয়োজন। আন্দোলনের আয়োজকেরা মাইকে ঘোষণা দিলেন আন্দোলনের খরচ জোগানোর জন্য সহায়তা করার জন্য। মঞ্চে রাখা একটি কাগজের বাক্সে সামর্থ্য অনুযায়ী যে যার মতো অনুদান রেখে গেলেন। সেখানে উপস্থিত রিকশাওয়ালা, বাদাম বিক্রেতারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেখানে টাকা দিয়েছিলেন। শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

  

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে যতগুলো আন্দোলন কিংবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছি সবগুলোই চলেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ীদের এ রকম চাঁদা বা অনুদানের ওপর নির্ভর করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজকের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন কোনোটাই কি এর ব্যতিক্রম ঘটেছে? আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা ইসলামপন্থী যেকোনো রাজনৈতিক দলের কথাই বিবেচনা করা যাক। সারা বছর ধরে দলগুলো যেসব কর্মসূচি ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেগুলোর অর্থের উৎস কী? গত বছরের ২৯ আগস্ট বাসসের এক খবরে জানা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ২০২০ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০২০ সালে আওয়ামী লীগের আয় হয়েছে ১০ কোটি ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৩ টাকা। দলটির দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ আওয়ামী লীগের আয়ের উৎস সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, মনোনয়নপত্র বিক্রি, বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের চাঁদা ও বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দেয়া অনুদান।

এ প্রসঙ্গগুলো উত্থাপনের কারণ হচ্ছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) চলমান আন্দোলনে সহযোগিতা করায় (অপরাধে!) সোমবার পাঁচজন প্রাক্তনীকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মঙ্গলবার তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এটা যেমন অভাবনীয়, অভূতপূর্ব এক ঘটনা, ঠিক আবার এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবও রয়েছে। গ্রেফতার দেখানোর পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিশরুল আরিফ যে ভাষ্য দিয়েছেন, সেটার দিকে একটু নজর দেয়া যাক। তিনি বলেন, ‘সাবেক ৫ শিক্ষার্থীকে আটকের মূল কারণ তাঁরা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন অর্থের জোগানদাতা হিসেবে এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে উসকানি দিয়ে অশান্ত করা এবং অন্যদিক প্রবাহিত করা। অর্থের জোগানদাতা হিসেবে তাঁদের উদ্দেশ্য কী তা-ও তদন্তে আসবে। যেমন জঙ্গিদের অর্থ জোগানদাতা আছে, আর এই অর্থ দিয়ে জঙ্গিরা কেবল খাবার খায় না, বরং এটা দিয়ে বোমা বানায় বা কেনে। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য কী তা আসবে তদন্তে।’

সিলেট জেলা তাঁতী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজাত আহমেদ লায়েকের করা মামলায় ওই পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা করার পেছনে তাঁর যুক্তি (!) হচ্ছে আন্দোলনের বিষয়টি তাঁর ভালো লাগেনি। আন্দোলনে যারা অর্থ দিয়ে সহায়তা করছেন তারা জামায়াত-শিবির।

যে পাঁচজন প্রাক্তনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের একজন হাবিবুর রহমান। তাঁর বন্ধু শাহ রাজী সিদ্দিকের বরাত দিয়ে ডেইলি স্টার-এর খবরে বলা হয়েছে, সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে শাহজালালের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তিনি ১০০০ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। তাঁদের গ্রেফতারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই যুগপৎ ক্ষোভ ও ভয়ের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে অনুজদের আন্দোলনে অনুদান দেয়া কি অপরাধ, সে প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন শুরুতে একটি হলের শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির আন্দোলন ছিল। ছোট ও সমাধানযোগ্য দাবিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যেভাবে বড় বিষয় করে তুলেছেন, সেটা তাঁদের অযোগ্যতা ও গোঁয়ার্তুমি ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে পুলিশ দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের আহত করা হলে সেটি উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৪ দিন চলা এই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে ১৬৩ ঘণ্টা অনশনে। এ সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলনে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা অভাবনীয় ঘটনা। তাঁদের এই আন্দোলন দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারা দেশের মানুষের সমর্থন ও সমবেদনা পেয়েছে। অনশনরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা-উৎকণ্ঠা ছিল সবার মাঝেই। সরকার সব দাবি মেনে নেবে এমন আশ্বাসে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অনশন ভাঙলেও উপাচার্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।

সারা দেশের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে যখন শাহজালালের শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে, সে সময় আন্দোলনে ‘ষড়যন্ত্র ও ইন্ধন’ দেখেছে শাবিপ্রবির উপাচার্য, দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। রীতিমত বিবৃতি দিয়ে তারা এ দাবি করে বসেন। এরপরই অনশনরতদের চিকিৎসাসেবা ও অর্থ সহায়তা নেওয়ার মুঠোফোন বন্ধ করে দেয়া হয়। সিআইডি সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। সরকারদলীয় এক নেতাকে দিয়ে মামলা করানো হয়। ‘জঙ্গি–জামায়াত শিবির’ তকমা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এই মামলা ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী বার্তা দিতে চাইছে?

প্রথমত, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বড় একটা বার্তা। সেটা এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও। ভবিষ্যতে ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’-এর এই অস্ত্রই সময়-সুযোগমতো রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে।

দ্বিতীয়ত, বিগত কয়েক দশকে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরগুলো ছেঁটে ফেলে ভয়ের একটা সংস্কৃতি জনমনে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আটক করে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র এই বার্তাটি জনমনে দিতে চায় যে নির্দিষ্ট চিন্তার বাইরে কেউ কিছু করলে সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ প্রাক্তনীকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘আন্দোলনে সহায়তা করা কোনো অপরাধ নয়। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সহায়তা করতেই পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থে লেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়েছে। আমি এই সম্মানীর টাকাটা আন্দোলনের ফান্ডে দিচ্ছি। এবার পারলে আমাকে অ্যারেস্ট করুক।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে সহায়তা দেয়ার কথা বলেছেন। পুলিশ কি এখন তাদের সবাইকে আন্দোলনে উসকানি কিংবা ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ তুলে গ্রেফতার করবে?

লেখক : মনোজ দে, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035679340362549